ভালোবাসুন, একদিন নয়, সারা জীবনের জন্য

রাবেয়া জাহান আভা:

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হলে থাকতে চারপাশে ভালোবাসাবাসির এতো ছড়াছড়ি দেখতাম যে মন ভালো হয়ে যেতো। বিকেল হলেই সহপাঠী, বন্ধু, বড়ভাই চেনা, অচেনা সব ছেলেরা, মেয়েদের হলের সামনে আসতো বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে, সঙ্গীকে একনজর দেখতে বা বিকেল-সন্ধ্যা একসাথে কাটাতে। সেই সময়টুকু তারা হারিয়ে যেতো ভালোবাসার কোনো এক অজানা ভুবনে। রাগ, ক্ষোভ, অভিমান, অভিযোগ সবকিছুকে সঙ্গী করেই চলতো ভালোবাসার দিনগুলো।

কেটে যেতো দিন, মাস, বছর। সেইসব ভালোবাসা কখনো রুপ নিতো প্রণয়ে, কখনো বা বিচ্ছেদে। তবু ভালোবাসা হারাতো না, থাকতো মনে। বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে বন্ধুত্ব হলেও কারো কারো ক্ষেত্রে তা একসময় গড়াতো ভালোবাসার সম্পর্কে। একপাক্ষিক অনুভবে তা কারও কারও হৃদয়ভঙ্গের কারণও হতো।  

বরাবরের মতো সেই সময়ও ভালোবাসতে না পারাটা যেন ছিল অযোগ্যতা। থাকতেই হবে নিজের কেউ-অনেকের মধ্যেই এক ধরনের শূন্যতা ভর করতো, যা জন্ম দিতো ভালোবাসার। অনেকগুলো বছর কাটাতে গিয়ে ভালোবাসার বিবর্ণ রুপও দেখেছি। আমার চেনা সহপাঠী, বন্ধু, বড়, ছোট ভাই বা বোন-এরকম অনেককেই নতুন নতুন সম্পর্কে জড়াতে দেখেছি। কারও কারও ভালোবাসার বাড়াবাড়ি দেখলে সত্যিই ঈর্ষা জাগতো মনে।

আমার পাশের ব্লকে লম্বা কেশের সিনিয়র এক আপু থাকতেন। যে ছেলেটির সাথে তার সম্পর্ক ছিলো সেই সুদর্শন যুবকটি কী ঘোরমাখা আবেগ নিয়েই যে প্রতিদিন হাজির হতেন প্রিয় মানুষটির কাছে! আমিই শুধু না, অনেকেই দেখতেন তাদের এই আবেগের বাড়াবাড়ি। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে একদিন না দেখলে যুবকটি হাজির হতেন দেবদাস রুপ নিয়ে।

রাজনীতির উত্তাপ মেয়েদের হলগুলোর দিকে কখনোই খুব একটা প্রভাবিত করতো না। তবু কোনো এক বিকেলে কী এক অজানা গোলযোগে এক শিক্ষক এসে হলের সামনে বা আশেপাশে যারা আছেন সবাইকে হলে ঢুকে যেতে বললেন। যদিও আমাদের হলে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞায় ছিলো বেশ কড়াকড়ি। সন্ধ্যের আগেই ঢুকতে হতো সবাইকে। না হলে সন্ধ্যের পর নাম লিখতো হতো খাতায়। পরপর কয়েকদিন নাম লিখলে কৈফিয়ত দিতো হতো হাউস টিউটরদের কাছে। সে ঝক্কি সামলাতেই সবার সন্ধ্যের আগে ফেরা। তো সব ভালোবাসা সারতে হবে সন্ধ্যের আগেই-এ ভাবনায় সবার মধ্যে তাড়া কাজ করতো।

সেই বিকেলে সবাই যখন হুড়োহুড়ি করে হলে ঢুকছিল, যুবকটি একেবারে গেটের কাছ ঘেঁষে এসে আপুটিকে বিদায় জানালেন। আর বারবার আশ্বস্ত হতে চাইলেন, প্রিয় মানুষটি অক্ষতভাবে ভেতরে ঢুকতে পেরেছেন। দেখে মনে হচ্ছিল, বিদায় যেন চির বিদায়! যুবকটির এই অতি আবেগ দেখে সে সময় আমরা কয়েকজন মিলে হাসাহাসি করলেও মনে মনে তো ঈর্ষিতই হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আহা! ভালোবাসার কি মধুর রুপ, রং আর টান।

কতো খুনসুটি আর আবেগের ‍দিনগুলো পার করে তারা একসময় পাশ করে বের হয়। সবার খোঁজখবর রাখা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তবু পরিচিত কারও সাথে কয়েক বছর পরে দেখা হলে বাকিদের সম্পর্কে জানতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক বিষয়। কোনো এক পরিচিত জনের কাছে জেনেছিলাম, সেই যুগলের বিয়ে হয়েছে। তারা ভালো আছেন। মনে মনে আশ্বস্ত হতাম, যাক ভালোবাসার জয় হয়েছে। ‍  

এর কয়েক বছর পর কোনো এক সকালে পত্রিকার পাতা খুলতেই দেখি আপুটির ছবি। লম্বা কেশের আপুটিকে হত্যা করা হয়েছে। পাশে সেই সুদর্শন যুবকের ছবি। ভালোবেসে ছবি হয়ে যাওয়া খবরে পড়ি, শ্বশুরবাড়ির একের পর এক প্রত্যাশিত যৌতুকের দাবি না মেটানোয় হত্যা করেছেন স্বামী নামের এক সময়ের প্রেমিক পুরুষটি। সেই প্রেমিক, যিনি ভালোবাসায় বিভোর থাকতেন প্রতিটি দিন, সেই প্রেমিক যিনি দেবদাস হয়ে যেতেন অবলীলায়। প্রেমে হত্যার ঘটনা নতুন কিছু নয় আমাদের সমাজে। তবু সেদিন সত্যিই এক মন খারাপ করা সকাল কেটেছিল আমার। হায় প্রেম! বাস্তবতার হিসেবে মেলানো সত্যিই কঠিন।

আসলে জীবনের বাস্তবতায় এই আকুল ভালোবাসাগুলোই এক সময় রুপ নেয় ‍বিবর্ণতায়, হিংস্রতায়। ভালোবাসায় একসাথে থেকেও ভালো থাকেন না অনেকেই, আবার শারিরীকভাবে না পেয়েও মনে মনে ধারণ করেন সে ভালোবাসা। কেউ বন্ধু হয়ে থাকেন, আবার কেউবা ভালোবেসেই বন্ধুহীন হন। তবু জয় হোক ভালোবাসার। সারা বছরের ব্যস্ততায় একটি দিনই যদি ভালোবাসার উৎসবমুখর দিনে পরিণত হয়, তাতে মন্দ কী? তবে মনে, কাজে, আচরণে তা যেন হয় সারাজীবনের পাথেয়।  

শেয়ার করুন: