ভয় কীসের মেয়ে, আড়ষ্টতা ছাড়ো

তানিয়া পলি: প্লিজ একটু সরে বসুন। যদি বা কিছুক্ষণ ঠিকঠাক থাকলো, আবার চেপে এসে এমনভাবে বসলো যে, ভদ্রবেশধারী অভদ্র পুরুষটির কাঁধ এসে আমার কাঁধকে ছুঁয়ে আছে। আর কিছু না বলে নিজেই এবার আরও আড়ষ্ট হয়ে চেপে বসি কাঁধ বাঁচাতে। অস্বাভাবিকভাবে অনেকক্ষণ আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকাতে রীতিমতো হাত ব্যথা করতে লাগলো

এবার হাত দুটোকে স্বাভাবিকভাবে রেখেই বসলাম। কিছুক্ষণ বাদেই বুঝতে পারি পাশে বসা ইতরটা আমার আড়ষ্টতার সুযোগে ইচ্ছেকৃতভাবে আমার দিকে আরো চেপে বসলো। এবার আর মুখে কিছু নয়, ডান হাতের কনুই দিয়ে জোরে এক ঠ্যালা মেরে বলি, এতোক্ষণ আমি যেভাবে হাত গুটিয়ে বসে ছিলাম, ঠিক সেভাবে বসুন।

আশেপাশের উৎসুক চোখগুলো একবার ঘুরে তাকালো। পাশে বসা ভদ্রবেশী ইতরটা গাঁইগুঁই করে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। যাই হোক ধমক আর গুঁতা খেয়ে এবার বাকিটা পথ সে হাত গুটিয়েই বসেছিল। জাহাঙ্গীরনগর থেকে মতিঝিল এর বাসে উঠি অফিসের উদ্দেশ্যে, তখন ঘটনা।

তানিয়া পলি

আমার মতো এ ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়নি, হয় না এমন কোনো মেয়েই নেই, প্রতিনিয়ত যাকে পাবলিক বাসে চলাচল করতে হয় আগের এরকম নানা অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি চুপচাপ আড়ষ্ট হয়ে বসে থেকে আদতে তেমন কোন ফায়দা নেই। অসভ্য লোলুপ পুরুষ তাতে শুধু আশকারাই পায় স্বীয় অসভ্যতা চরিতার্থ করতে। আর নিজের ঝুলিতে জমা হয় চরম অস্বস্তিপূর্ণ, তিক্তকর সেই বাজে অভিজ্ঞতাগুলো

দেখুন আমি নারীবাদীও নই, পুরুষ বিদ্বেষীও নই। হঠাৎ অপরিচিত কোনো পুরুষের শরীরের অনাকাংখিত কোনো স্পর্শে আমার একেবারে জাতমানইজ্জতই চলে যাবে, এহেন সস্তা অনুভূতিও আমি লালন করি না, কিংবা ওই পর্যায়ের হীনমন্যতাকেও আমি পোষণ করি না আমাতে। মরীয়া হয়ে নিজেকে একজন প্রতিবাদী নারী হিসেবে প্রকাশের বা প্রতিষ্ঠার কোনো আকাংখাও আমার মধ্যে কাজ করছে নাআমি শুধু জানি এবং বিশ্বাস করি সঠিক সময়ে সঠিক প্রতিবাদটা ভীষণভাবে জরুরি!

আমি শুধু উদ্ভুত পরিস্থিতি স্বীয় অভিজ্ঞতা নিয়েই কথা বলছি। তবে হ্যাঁ, নিজের জন্য অনাকাংখিত কোন বিষয়কেও প্রশ্রয় দিতে, ছাড় দিতে আমি একবিন্দু রাজী নই।

দীর্ঘশ্বাস নিয়েই বলতে হচ্ছে অহেতুক আড়ষ্টতায় নিজেকে যখন মুড়ে রাখি, মুড়ে থাকি, থাকতে বাধ্য হই কিংবা পছন্দ করি বলেই আমরা এই মেয়েরা প্রতিনিয়ত নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমাই তিক্তকর এহেন যত ঘটনা। আর এসব অনাকাংখিত ঘটনা এড়ানোর জন্য সবকিছুর উপরে যেটা আগে দরকার তা হলো, নারীপুরুষ নির্বিশেষে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ দৃষ্টিভঙ্গিকে উন্নত করা।

আমি এও দেখেছি পাবলিক বাসে এরূপ ভিক্টিম কোনো মেয়ে যখন একটু উচ্চস্বরে প্রতিবাদ জানায়, তখন বাসের অন্যান্য পুরুষসহ আমরা মেয়েরাও মুখে কুলুপ এঁটে নিশ্চুপ বসে থাকি।আবার বাসের অন্যান্য মেয়ে যখন চুপ করে থাকে তখন একই মানসিকতার কিছু কিছু অভদ্র পুরুষকন্ঠ অসভ্যতা করা সেই পুরুষটির পক্ষ নেয় জোটবেঁধে। আর ভিক্টিম মেয়েটা বানিয়ে বলছে, মিথ্যে অভিযোগ করছে এটা প্রমাণের আয়োজন করে ফেলে। এমন ঘটনাও নিত্য দৃশ্যমান

গা বাঁচিয়ে চলা, চুপ করে থাকা নারীপুরুষ সবাইকে বলি, আজকের এই ভিক্টিম হয়তো আপনার কেউই নন, তাইতো আপনি এভাবে চুপ করে আছেন তবে একবার ভাবুন তো আপনি সকালে অফিস বা কাজের উদ্দেশ্যে বাসে চড়ে আছেন আর এই ঘটনার সাক্ষী হলেন নীরব দর্শক-শ্রোতারূপে। আর ঠিক বিকেলেই আপনার স্ত্রী অফিস বা শপিং শেষে কিংবা আপনার তরুণী বোন/কন্যাটি যখন স্কুল/কলেজ শেষে বাসায় ফেরার পথে বাসে এরকম হেনস্তা হবার ঘটনা আপনাকে শোনাবে, তখন আপনার কেমন লাগবে ওহে গৃহকর্তা, ওহে ভাই, ওহে বাবা!

বাসের সেইসব ভদ্র, নীরব যাত্রী, চুপচাপ আপুমনি/আন্টি আপনাকেও বলছি, কাল কিন্তু আপনারই পালা। ভুল বলছি না, মিলিয়ে নিয়েন

আর সবশেষে বলতে চাই, কেউ সমর্থন করলো কী করলো না, তা দেখার সময় নেই, প্রয়োজনও নেই। পরিবেশ যথাসম্ভব নিজের আয়ত্বে, অনুকূলে নিয়ে আসতে হবে নিজেকেই। বিন্দুমাত্র অমন কোন অসঙ্গতি টের পাওয়া মাত্রই জড়তা ভেংগে আড়ষ্টতাকে হটিয়ে দিয়ে প্রতিবাদ করে উঠুন। ঠিক সময়ে সঠিক প্রতিবাদ কাজে আসবেই, নিশ্চিতভাবেই বাকি পথটুকু আপনি চরম অস্বস্তিদায়ক সেই পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হবেন।
শেষবেলায় আবারও বলতে চাই————

নির্ভয়ে আড়ষ্টতা পরিহার
পরিবেশ অনুকূলে আপনার

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.