রোকসানা ইয়াসমিন রেশনা: আজকের লেখাটা দীর্ঘদিন ধরে মনের ভিতরে উঁকি-ঝুঁকি দেয়া ভাবনা থেকে আসছে। যেটা খুব বেশীক্ষণ মনে স্থান করে নিতে পারেনি কখনই। বেড়াতে আসা অতিথিদেরও তো কখনও কখনও মনে পড়ে, কাজেই ধরে নেই এটা আমার বিপরীতমুখী অতিথি ভাবনা।
নব্বই দশকের কোনো একটা সময় থেকেই আমি নচিকেতার গানের দারুণ ভক্ত। খানিকটা অনুপ্রাণিতও। এই গান শুনতে শুনতেই দেখি একদিন উনি গেয়ে ফেলেছেন, ‘আমি ভবঘুরেই হবো এটাই আমার এ্যাম্বিশন।’ ভাবলাম, আরে এই লোকটা আমার মনের কথা ক্যামনে প্রকাশ করলো? আসলে আমার মনে হয় উনি সবার মনের কথাই হয়তো কোন না কোন গানে প্রকাশ করে ফেলেন।

তেমনি একটা গান খোকন। গানের শিরোনামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলে খোকন। সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার পর যার মা লিভ টুগেদার করছে, বাবা আবার বিয়ে করেছে। বিষের শিশি হাতে নিয়ে হোস্টেলে বসে মা-বাবা একত্রে থাকার সময়ের সুখ-স্মৃতি মনে করছে একবার, তারপর আবার এখনকার জীবনের কথা ভাবছে। বুঝতে পারছে না সে মরবে, না বেঁচে থাকবে।
গানের বিষয়বস্তুটা নিয়ে অনেকদিন ভেবেছি। সমঝোতায় অনেক কিছু হয়, আবার হয়ও না। কিন্তু সমঝোতায় যে সংসার হয় না, সেটা ঠিক। ভালোবাসা, ভালোলাগা, বিশ্বাস না থাকলে আসলেই সংসার হয় না। কিন্তু আমার ঐ যে প্রচণ্ড জেন্টেল ব্রোকেন ফ্যামিলি গার্ল কলিগটা, যার গায়ে হলুদ হয়ে যাওয়ার পরও বিয়েটা ভেঙ্গে গিয়েছিল বা ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হয়েছিল, সে রকম ঘটনা মনে করেও কিন্তু সমঝোতা করা যায়।
বেশ কিছুদিন আগে আমার হাজব্যান্ড এর কাছে একটা ঘটনা শুনেছিলাম। স্বামী-স্ত্রীর প্রচণ্ড মতের অমিল থাকা সত্ত্বেও একই বাসায় আলাদা দুই রুমে বসবাস করে বিবাহিত জীবনের ৪৫তম বছর পালন করে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। তখন তাদের বয়স হয়ে গিয়েছিল যথারীতি ৬৫ ও ৭০ বছর।
তাদের শর্তই ছিল, সব থেকে ছোট সন্তানটি যেদিন স্বাবলম্বী হয়ে যাবে তারপরেই তারা জেন্টেল এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে আলাদা হয়ে যাবে। এর মাঝখানে তারা একজন আরেকজনের কোন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। ছেলেমেয়েদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে, এই রকম কোন কাজও করবে না। এতে করে লাভের লাভ হবে ছেলেমেয়েদের জীবনটাও অনিশ্চয়তার মাঝে পড়লো না।
সেদিন আনন্দবাজার পত্রিকায়ও একই রকম একটা প্রতিবেদন পড়লাম। ছেলেমেয়েরা স্বাবলম্বী হয়ে যাবার পর সেপারেশনের হার দিন দিন বাড়ছে। এক্ষেত্রে এক বাসায় থেকে যাওয়ার কারণ ঐ একই ছিল।
জীবনের সবক্ষেত্রেই কোন না কোনভাবে সমঝোতা করে চলতেই হয়। আর এই সমঝোতাটা ছেলেমেয়ের কথা ভেবে স্বামী স্ত্রীর মাঝে হলে উত্তরায় ডিভোর্সি সাংবাদিকের দুইটা ছেলেমেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটতো না, চট্টগ্রামের ক্যানসার আক্রান্ত মেয়েটা যে ফেসবুকে তার মৃত্যুর কাউন্ট ডাউন করে পোস্ট দিতো, তার মা-বাবার মাঝের ঝগড়া দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠার কষ্ট নিয়ে মারা যেতে হতো না। আহারে মেয়েটা! মরার আগেও মা-বাবার মাঝে সুসম্পর্ক দেখে মরতে পারলো না। কোনো খোকনকেও বিষের শিশি হাতে নিয়ে ভাবতে হতো না সে কী করবে!
জয় হোক সাময়িক ভাবনার, জয় হোক সমঝোতার। ভালো থাকুক সন্তানেরা। আর তাদেরকে ভালো রাখুক মা-বাবারা।