ফাতেমা জোহরা:
“যে কামনা নিয়ে মধুমাছি ফেরে
বুকে মোর সেই তৃষা !
খুঁজে মরি রূপ, ছায়াধূপ জুড়ি,
রঙের মাঝারে হেরি রঙডুরি!
পরাগের ঠোঁটে পরিমল- গুঁড়ি — হারায়ে ফেলি গো দিশা!”

… এই খুঁজে ফেরা, দিশা হারানো, এরই নাম প্রেম। নোভালিস প্রেম সম্পর্কে বলেছেন: “জগৎ হয়ে যায় স্বপ্ন আর স্বপ্নের জগৎ”
” love possesses not nor would it be possessed ;
For love is sufficient unto love. ( Kahlil Gibran)
এতো গেল পূর্ণতার কথা, পেজের উল্টো দিকটা হচ্ছে :
” হারায়ে গেছে অন্ধকারে – পাইনি খুঁজে আর
আজকে তোমার আমার মাঝে বন্ধু সপ্ত পারাবার।”
… এই যে সপ্ত পারাবারের বিচ্ছিন্নতা, এই বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা আর কষ্টই হচ্ছে প্রেম, এই বিচ্ছিন্নতার দীর্ঘশ্বাস মেঘদূত, তাজমহল জুড়ে।
প্রেমে হাসির মুহূর্ত ক্ষণকালের, কান্নাই চিরদিনের। চণ্ডিদাস লিখেছিলেন:
“হাসিতে হাসিতে পিরীতি করিয়া
কাঁদিতে জনম গেল।”
প্রেমের দিনগুলোতে যে আবেগের উত্তুঙ্গতা থাকে তা মানুষের পক্ষে বেশিদিন বয়ে বেড়ানো সম্ভব হয় না। আমরা চাই বা না চাই কিছুদিনের মধ্যে প্রেমকে বিদায় দিতে হয়। (১) প্রেমকে হত্যা করে (২) প্রেমকে বন্ধুত্বের পর্যায়ে নামিয়ে সহনীয় করে তোলা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন: প্রেমের বয়স কিছুতেই তিনমাসের বেশি নয়।
প্রেম কি আসলে মরে? গালিব বলেন: এ এমন এক আগুন, গালিব, যা জ্বালালে জ্বলে না, নেভালে নেভে না।
আমরা যাকে ভালবাসি তাকে গোটা হৃদয়টাই দিয়ে বসি, বিনিময়ে গোটা হৃদয়টাই চেয়ে বসি।
প্রেম দু’রকম হতে পারে, না পেয়েও হতে পারে, আবার পাওয়ার ভেতর না পাওয়ার অনুভূতি দিয়ে হতে পারে। ১২০৬ সালে বুন্দেলমন্ত হত্যাকাণ্ডের ফলে নির্বাসিত কবি, বিয়েত্রিস প্রেমী দান্তে তাঁর ডিভাইন কমেডিতে বুন্দেলমন্তকে শাপান্ত করে লিখেন :
” হায় বুন্দেলমন্ত! কার প্ররোচনায় তুমি বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে গেলে! নেমে এলো অভিশাপ।
কৃষ্ণের অসীমতার বিস্ময় শেষ করতে পারে না বলে রাধার মধ্যে না – পাওয়ার অস্থিরতা, কাছে পেয়েও মনে হয় পাওয়ার বাইরে সে।
” দুঁহু কোড়ে দুঁহু কাঁদে বিচ্ছদ ভাবিয়া’
ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন কাছে থাকা মানে পাওয়া নয়, কাছে থাকার মধ্যে থাকতে পারে লক্ষ যোজনের ব্যবধান।
এ হলো সেই শাঁখের করাত ‘ যা আসিতে যাইতে কাটে।
না – পাওয়ার মধ্যে প্রেমের তীক্ষ্ণতা বোঝা যায়, কিন্তু পাওয়ার মধ্যে কি প্রেম থাকতে পারে না?
জিবরান এর উত্তর দিয়েছেন:
” love one another but make not a bond of love.
But let there be spaces in your together.”
যাকে আমরা ভালবাসি প্রথমে তার কোন একটি দিক হয়তো কোনো গুণ, হয়তো রূপ বা ব্যক্তিত্বের কোনো একটি দিক আমাদের ভাল লাগে, তারপর সে ভালবাসার রঙ ধীরে ধীরে তার বাকী সবকিছুর উপর ছড়িয়ে যায়। যে ছিল দশজনের একজন, সে হঠাৎ একাদশ হয়ে উঠে, এভাবে বড় হতে হতে সে জীবনের চেয়ে বড় হয়ে উঠে, একচ্ছত্র ঈশ্বর হয়ে বসে।
ধরুন, কাউকে আপনার ভালো লেগে গেল, বা কারো জন্য আপনার দিন -রাত্রির ঘুম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, এই যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য মরীয়া হয়ে বারবার সেই কারোর ভালবাসা চাওয়া, রবার্ট ব্রুসের ধৈর্য্যের পরীক্ষায় সফলতা হয়তো আসে, নাছোরবান্দার মতো লেগে থাকলে ফল হয়তো আশা করা যায়, এভাবে পাওয়া কি প্রেম? এতো দয়া, করুণা। করুণার মধ্যে ভালবাসা নেই। প্রেম চিরদিন তোলা থাকে দুর্লভের জন্য, অপ্রাপনীয়ের জন্য।
কৃষ্ণ আর রাধার মধ্যে কার ভালবাসা সবচেয়ে বেশি? কৃষ্ণ রাধার তুলনায় অনেক বৈভবময়, গাছের উঁচুতম ডালের ফুল। কৃষ্ণের কাছে রাধা অস্তিত্বের তুচ্ছতা দিয়ে ঘেরা সাধারণ একজন। তার জন্য কৃষ্ণের ভালবাসা তীব্র হবে কেন? যেমন হয়নি ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ এ ভ্রমরের জন্য গোবিন্দলালের প্রেম, ‘কবি’ উপন্যাসে ঠাকুরঝির প্রতি নিতাই চরণের ভালোবাসা।প্রেমের ক্ষেত্রে পুরুষের প্রতাপ একছত্র।
আর এক ধরনের প্রেম গড়ে উঠে হৃদয়ের তপ্ত, উচ্ছ্রিত আবেগের উপর নির্ভর করে। লাইলী – মজনু, শিরি – ফরহাদ, দেবদাস – পার্বতীর প্রেম এই ধরনের। পৃথিবীর অধিকাংশ প্রেম এ জাতের। এ ঠিক প্রেম নয়, মোহ। এর ভিত্তি মানুষের সবচেয়ে অনিত্য জিনিস: আবেগ। আবেগ শেষ হলে এই প্রেম ঝরা ফুলের মতো অবহেলায় পড়ে থাকে।
আবেগ শ্রদ্ধা আর পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উপর ভিত্তি করে যে প্রেম তাই গভীর ও চিরস্থায়ী প্রেম। জ্যাঁ পল সার্ত আর সিমন দ্য বেভোয়ার এর উদাহরণ দেওয়া যায় এক্ষেত্রে। এ প্রেম কেবল আবেগ বা শ্রদ্ধার স্বার্থে নয়, বরং জীবনের স্বার্থে। এজন্যই এ প্রেম চিরায়ু।
মানব – অস্তিত্বের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি প্রেম, যা মানুষকে অমরত্বের স্বাদ দেয়। তার চেয়ে বড় কিছু কেবল এই জীবনে কেন, কোনোখানেই নেই।