ভালবাসা মন্দবাসা

নওরীন তামান্না: এক বন্ধুর বউ তাকে একবার অভিযোগ করে বলেছিলো “কই, তুমিতো আমাকে একটুও ভালোবাসো না!” বন্ধু হেসে বলেছিলো, “ভালো না হোক, মন্দ তো বাসি নাই”।
শুনে আমার চমক লেগেছিলো তখন। মন্দবাসা? সে আবার কি? জবাব পেতে খুব দেরী হয়নি।

নওরীন তামান্না

এক পরিচিত দম্পতির গল্প বলি। দু’জনেই সমবয়সী। বিয়ের আগে প্রেম পর্যায়ে দেখা গেলো ফুল, চকোলেটের ছড়াছড়ি। দুইজনের চোখের ইশারায় কথা। প্রেমের দৌরাত্ম এমনই উৎকট যে ভদ্রতা রক্ষা করে সামনে বসে থাকা দায়। বিয়ের পর দেখা গেলো হঠাৎ করে “বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে”। কী হয়েছে? মেয়েটি চাকরিতে ঢুকেছে এবং কয়েক মাস পরে তার বেতন বেড়ে হয়েছে ছেলেটির চেয়ে বেশি! ছেলেটি একসময় গর্ব করতো প্রেমিকাকে নিয়ে। বিয়ের পর দেখা গেলো স্ত্রী আর প্রেমিকা দুটি কিছু ভিন্ন জীব। স্ত্রীর চাকরি যদি বা সহে, বেশি বেতনটা আর কিছুতেই সহে না।

আরেক শিক্ষিত দুর্দান্ত সাহসী “পুরুষ”, বিয়ের আগে প্রেমিকার একটু দেখা পেতে, কথা শুনতে রাতভর জেগে থাকতেন। লিখতেন দারুণ সব কবিতা। বিয়ের পরেও লেখেন। বিক্রমী সেইসব কবিতারা ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে তার স্ত্রীর শরীরে, গায়ে, পেটে নাকে- বিভৎস সব ক্ষত হয়ে।

মেয়েটির গল্প শোনাই। নিরীহ, মাথায় কাপড় দেওয়া মেয়েটি ভালোবাসে নীরবে। প্রেমিকের চোখে সে পারফেক্ট নারী। পারলে সে জীবনটি দিয়ে দিতে প্রস্তুত মেয়েটির জন্য। প্রেমের জন্য নয় গজ নাকি ঘুরতে হয়। ছেলেটি ঘুরলো বারো গজ। কিন্তু এই জালিম দুনিয়ায় জীবন দেওয়া যতো সহজ, চাকরি পাওয়া বোধ হয় ততোটা নয়। একদিন হঠাৎ করে সব যোগাযোগ বন্ধ। ছেলেটি খোঁজ নিয়ে জানলো বিয়ে হচ্ছে মেয়েটির এক প্রতিষ্ঠিত মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের সাথে। ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে ফোন দিলো।

মেয়েটি বললো, “ভাইয়া (!!), বাবা-মাকে কষ্ট দিলে গুনাহ হবে। প্লিজ তুমি ভুলে যাও আমাকে।”

ক’দিন আগে লন্ডন যাচ্ছি এক বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রণে। কাজের চাপে দমবন্ধ। বহুদিন পর বন্ধুদের সাথে দেখা হবে, আড্ডা হবে – সেই খুশিতে শাড়ি পরেছি, সাজগোজ করেছি, এমনকি টিপও দিয়েছি একখানা। পথে নেমে দেখা গেলো পুরা গ্রিডলক ট্র্যাফিক। এক ইঞ্চিও নড়ছে না কোন কিছু। ঘন্টা দেড়েক জ্যামে আটকা থাকার পর মুখ কালি করে বললাম “শাণ, আজ আর যেয়ে কাজ নেই। কয় ঘণ্টায় এই ট্রাফিক কাটবে কে বলতে পারে। চলো যেকোনো একটা এক্সিট ধরে বাড়ি ফিরে যাই।”

ডাবল-আর এর শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না। এই অবস্থায় ট্রাফিক ঠ্যাঙ্গানোর অবস্থা তার একেবারেই নেই। সামনেই একটা এক্সিটের উদয় হলো হঠাৎ। দেখলাম, সে গাড়ি ঘোরাচ্ছে না। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললো, “এতো কষ্ট করে সাজগোজ করেছো। চলো যত ঘণ্টাই লাগুক, তোমাকে নিয়ে যাবো।”। তারপর হেসে দিয়ে বললো “আমরা মজলুম ড্রাইভার মানুষ, একটু-আধটু কষ্ট আমাদের গা সওয়া”।

আমার পিএইচডি শেষ হয়েছিলো ডাবল-আর এর আগে। মনে পড়ে ভাইবা শেষ হলে একগাদা ছাত্র=ছাত্রী আর শিক্ষকদের উপেক্ষা করে তীরবেগে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে প্রায় মাটিতে ফেলে দিয়েছিলাম। সেদিন তার মুখে যে আনন্দ দেখেছি, তার নিজের পিএইচডির দিনেও সেই আনন্দ দেখিনি।

মনে মনে বললাম “ওয়েল ডান মি। সখা, ভালোবাসিয়াছো কিনা জানি না, তবে মন্দ বাসো নাই।”

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.