বখাট্য যুক্তি- নারী নারীর শত্রু

তামান্না তাবাসসুম: কেউ নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে কিছু বললে বা লিখলে সেখানে কেউ না কেউ বলবেই বলবে-নারীরাই নারীর শত্রু। যার ফলে মনোযোগ ঘুরে যায় অন্যদিকে আর ইস্যুগুলোকে দুর্বল করে দিতে সুবিধা হয়।

ছোটবেলা থেকেই আমরা কিছু প্রবাদ বচন শুনতে শুনতে মনে ধারণ করি যা কেন বলছি এর পিছনের যুক্তিগত দিক আর চিন্তা করি না। নারী নারীর শত্রু সেরকমই এক মুখস্থ বচন এই কথাটা ভয়াবহ রকমের স্টেরিওটাইপিং।

এখন দেখা যাক কথাটা আমরা কেন বলি। কাজের মেয়ে নির্যাতন, বউ-শাশুড়ি ঝগড়া, বাসে দুই নারীর সামান্য কথা কাটাকাটি, দুই বান্ধবীর মধ্যকার ঝামেলা, কমেন্ট বক্সে দুই নারীর মতের অমিল, মোটামুটি এই কয়ক্ষেত্রেই আমরা বলি নারীরাই নারীর শত্রু।

তামান্না তাবাসসুম

যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নারীকে নারীর শত্রু বলছেন, সেই অর্থে, সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতেই পারি, পুরুষ পুরুষের শত্রু। সম্পত্তি নিয়ে দুই ভাই, বাপ-ছেলে, চাচা-ভাতিজা খুনোখুনি, ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটি হলে রিকশাওয়ালা/বাসের হেলপারের গায়ে হাত তোলা, কাকাভাইপোর মারামারি, শশুড়বাড়ী থেকে কাকে কেমন ট্রিট করলো এই নিয়ে ভাইরাভাইয়ের হিংসা, বন্ধুকে নেশার জগতে নিয়ে যাওয়া,চুরি, ডাকাতি, ঘুষ খাওয়া, গুম-খুন বলে শেষ করা যাবে না এত্তো উদাহরণ। সে সময়

কেউ বলে না, আহা, ও পুরুষ, তুমিও পুরুষ, আমিও পুরুষ, এমনটা না করি! আমরা খুব সহজ একটা কথা বুঝতে চাই না তা হল ভালমন্দ কখনও লিঙ্গ হিসেব করে হয় না, হয় ব্যক্তিতে। এখন যারা ক্রিমিনাল তারা তো ক্রিমিনালই, তাদের আলাদা কোন দেশ, জাতি, জেন্ডার, কিচ্ছু নাই। এদের জাতটাই আলাদা।

কোন নারী কোন ক্রাইমে জডিয়েছে এমন খবর এলেই সবার মুখে একই কথা, নারী হয়ে কিভাবে এমন কাজ করতে পারলো? কই পুরো পত্রিকার সব পাতায় পাতায় যে পুরুষের ক্রাইমের গল্প, তখন তো কেউ বলে না পুরুষ হয়ে কেমনে এই কাজ করলো? নারী হয়ে কিভাবে এমন কাজ করতে পারলো এই কথা বলার মানে কিন্তু মেয়েরা অনেক ভাল হয়, কিন্তু এই মেয়ে কিভাবে খারাপ হইলো এইটা না। এমনটা হইলে তারা ফেসবুকে সারাদিন নারী বিদ্বেষী পোস্ট দিতো না। এর উদ্দেশ্য হলো তিলকে তাল করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যে মেয়ে মানুষ কত্তো খারাপ।

নারীই নারীর শত্রুএটার প্রমাণ হিসেবে সবচেয়ে বেশি যে চিত্রটাকে দেখানো হয় সেটা হলো বউ-শাশুড়ি সম্পর্ক। বিষয়টা আসলে এতোটা সহজও না।
যে সমাজে শ্বশুরবাড়িতে মেয়েরা থাকে না, এবং মেয়েরা অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর, এবং লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হয় না , সেখানে বউ-শাশুড়ির মধ্যে তো কোনও ঝগড়া হয় না! ঝগড়ার পেছনে পরনির্ভরতা এবং পিতৃতন্ত্রের একটা বড় ভূমিকা আছে।

বেশীরভাগ সময়েই শাশুড়ি হিসেবে যে মহিলা থাকেন, বউ হয়ে আসার পর তাকে জীবনের সব সাধ আহ্লাদই বিসর্জন দিতে হয়েছিলসংসারের বাইরে তার কোনো জগৎ নেই, সংসারে তার সিদ্ধান্তের কোন দাম ছিলো নাতারপর কিছুটা অবস্থান তৈরি করেছেন পুত্র-সন্তান জন্ম দিয়ে! সে তার জীবনের সকল না পাওয়া ভূলে থাকে সন্তানকে বুকে নিয়েতখন ওই নারীর জীবন হয়ে যায় পুরোপুরি সন্তান কেন্দ্রিক। তাই ছেলের প্রতি খুব বেশি পজেসিভ হয়ে থাকে এই সব মায়েরা। ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “বউ পেলে আমাকে ভুলে যাবি নাতো বাবা?”

এটা আসলে বেচারীর সারভাইভাল লড়াই ছাড়া আর কিছুই না। চিরকাল প্রায় গৃহবন্দী একজন নারী ছেলে বড় হওয়ার পর হাতে ক্ষমতা পান। শাশুড়ির সদ্যপ্রাপ্ত ক্ষমতার বলি হয় নববধূ। এখানে শাশুড়ি পুত্রবধূকে মেয়ে হিসেবে নির্যাতন করেন না, বরং তার এতোদিনের জমে থাকা না পাওয়ার আক্ষেপ আর স্বল্পবুদ্ধিতার কারণে নির্যাতন করেন। এই ক্ষমতা যেন কিছুতেই হারিয়ে না যায় তাই ছেলেকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে বউ থেকে কিছুটা দূরে নিজের কবজায় রাখতে চান। এটা আসলে বেচারীর টিকে থাকার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই না।

শাশুড়ির যদি সংসারের বাইরে নিজের একটা জগৎ থাকতো, যদি বউ হয়ে আসার পর থেকেই তার মতামত চাওয়া-পাওয়ার দাম থাকতো, তাহলে তিনি এমন হয়ে যেতেন না।
এটা অনেকটা র‌্যাগিং এর মতো। প্রথম অবস্থায় ছাত্র একটা ভয়াবহ মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়, তারপর তাকে বোঝানো হয় যে এটা মেনে নেয়া তোমার ভদ্রতার পরিচায়ক। এভাবে সে একটা সিস্টেমের মধ্যে পড়ে যায়, আর পরের বছর জুনিয়র ব্যাচের সাথে একই কাজ করে। কোন পরিবারে বউ শাশুড়ীরা কিন্তু ঠিক এই সিস্টেমেই পড়ে যায়। এটা নারীর আলাদা বৈশিষ্ট্য না।
যেই ছাত্র আগের বছর যতো বেশি র‍্যাগ খায়, সেই পরের বছর জুনিয়রদের তত বেশি র‌্যাগ দেয়। এটাই মানুষের কমন বৈশিষ্ট্য, এখানে পুরুষ-নারী কিছু নাই। খুব বিশাল মনের কেউ হলে তার কথা ভিন্ন।  

মেয়েরা নাকি ভালো বন্ধু হয় না? বাহ! তার আপনাদের মতো চা দোকানে আড্ডা দেয়ার অধিকার নাই, বাড়ির বাইরে কোথাও গেলে সময় গুনে গুনে বলে দিতে হবে কখন আসবে, তার জন্য সূর্যাস্ত আইন আর বিয়ের পরের অবস্থা আর নাইবা বললাম।
তারপর আবার তার জন্য তৈরি আছে একশ একটা রেডিমেড গালি। একটা ছেলে তার বন্ধুকে পালিয়ে বিয়ে করতে সাহায্য করে যদি জেলও খাটে তাহলেও তার উপর সামাজিক, পারিবারিকভাবে তেমন চাপ পড়ে না। একই জিনিস যদি একটা মেয়ের ক্ষেত্রে হয়, তাহলে তার উপর কী ভয়াবহ প্রভাব পড়বে, ভাবতে পারেন?
মেয়ে মেয়ের বিপদে রাত ১২টার সময় বেরিয়ে আসতে পারে না। তাকে বাসা থেকে বেরিয়ে আসতে দেয় না আপনাদের সমাজ।
সমাজই মেয়েদের ইউনাইট হতে দেয় না, তার নিরাপত্তা দেয় নানিজে পায়ে শেকল পরিয়ে নিজেই বলে তুমি উড়তে পারো না, এটা তোমার অযোগ্যতা। নারীকে শোষণ করতে শুধু বাইরে দেয়াল টানলে তো চলবে না, সেটা আরও শক্তপোক্ত করার জন্য দরকার মনের দেয়াল টেনে দেয়ার, তাই ব্যবহার হয় এসব বচনের।

হিটলারের পরামর্শক গোয়েবলসের থিউরি অনুযায়ী কোন মিথ্যা বারবার কানের সামনে বলতে থাকলে তা সত্য বলে মনে হয়। এসব প্রবাদ এতো প্রচালিত যে পান থেকে চুন খসলেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার এই বচন মনে পড়ে যায়, আর মনে হয় নারীরাই তো নারীর শত্রু। এই কথাটা নারীর প্রতি যেকোনো অন্যায় ধামাচাপা দেয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্র। এই প্রবাদটার ব্যবহার বন্ধ করুন প্লিজ।      

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.