নিজের জন্য বাঁচো মেয়ে

নাঈমা চৌধুরী:

শববাহী মিছিলটা থেমে গেল হঠাৎ
আত্মার আর্ত চিৎকারে, 
থামো…কোথাও নিয়ো না ওকে, 
ওই দেহে লেখা আছে বঞ্চনার সমগ্র ইতিহাস। 
ব্যবচ্ছেদ করে দেখ, 
মিলে যেতে পারে স্বপ্ন কোনো, 
ওই নিষ্পলক চোখে।
নাহ্…ভুল বললাম, 
স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিয়েছে সে বহুকাল,
ওখানে এখন পাবে কেবলই দু:স্বপ্ন।
চোখের কোলে কালো দাগ দেখে 
কাজল ভেবো না, 
সেটা ওর নির্ঘুম রাতের সাক্ষী। 
রঙিন ঘুড়ির কাগজে ঠোঁট রাঙিয়ে,
তেপান্তর পেরিয়ে ছুটে চলা সেই দূরন্ত কিশোরী, 
আচমকা ঘরকুনো হয়ে উঠেছিল
অনাকাক্ষিত এক চুম্বনে। 
কামের সংজ্ঞা তখনও জানা ছিল না তার,
বোঝেনি সে, তার রাঙানো ঠোঁটের
কোনো অন্য মানে করতে পারে কেউ।
বাবা বলত, ওই হাসি দিয়ে নাকি
বিশ্ব জয় করা যায়, 
কিন্তু বিশ্ব জয় করতে তো চায়নি মেয়েটা
শুধু নিজের, একান্ত নিজের
ছোট্ট একটা ভুবন চেয়েছিল। 
আর তারও অনেক পরে
মনের গহীণে একটা আশা জেগেছিল শুধু, 
একজন মানুষের মন জয় করবে একদিন
আর রাজত্ব করবে সেখানে 
দাপটের সাথে একা। 
তখন সে তরুণী, 
তখনও তার স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্ন হয়ে যায়নি। 
তখনও তার সরল চোখে
এই অনন্ত পৃথিবীর সবই সুন্দর দেখাতো।
হ্যাঁ…একটা মানুষকেই মানুষ ভেবে
ভুল করেছিল সে,
সেই মানুষ নামক অমানুষটা তাকে 
জয় নয়, অধিকার করতে চেয়েছিল।
মন ছিল কি তার?
অনুভব করেনি তো কোনদিন। 
ওই দেহে যত কালশিটে, কাটাছেঁড়া দেখবে
সবই সেই অমানুষটার দান। 
তবু বেঁচে ছিল মেয়েটা, 
বাঁচতে চেয়েছিল। 
বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে নয়,
তার জঠরে তিল তিল করে বাড়ছিল
ছোট্ট যে প্রাণ তাকে বাঁচাবে বলে।
কিন্তু…বাঁচতে দেয়া হয়নি তাকেও, 
ভালোই হয়েছে আসেনি সে,
বেঁচে গেছে…বড্ড বেঁচে গেছে,
মেয়ে হয়ে জন্মাতে হয়নি
এই অমানুষদের পৃথিবীতে।
গলায় যে দাগটা দেখছ
সেটা নিজের দেয়া,
ওটা কিছু নয়, ওটা ছিল মুক্তি। 
ওই দেহে সবচেয়ে ছিন্নভিন্ন যে প্রত্যঙ্গটি
শত ব্যবচ্ছেদেও দেখতে পাবে না তোমরা,
ওটা হৃদয়, 
ওটা এখন বড্ড শান্ত।
… আমার এই কবিতাটি পড়ে এক ছোট ভাই প্রশ্ন করেছিল, সত্যিই কি মুক্তি মেলে, আপা? সত্যিই কি হৃদয় শান্ত হয়? তাকে যে উত্তরটা দিয়েছিলাম আজ আবারও তাই বলবো, জানি না, সত্যিই জানি না আমি। 
মৃত্যুর মিছিলটা শুধু ক্রমাগত বড় হতে দেখি। সেই মিছিলে যুক্ত হয় একের পর এক মুখ, একের পর এক নাম। কেউ কেউ আবার অজ্ঞাতনামাই থেকে যায়। একের পর এক আত্মহত্যার খবর পড়ি আর ভাবি কী সেই বিপন্ন বিস্ময় যা তাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করে? এক সুতোয় বেঁধে দেয় গাঁয়ের সাধারণ বধূ থেকে শুরু করে মডেল, অভিনেত্রী, লেখক, কবি, সরকারী কর্মকর্তা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে পর্যন্ত?
তারপর একসময় দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলে অনুধাবন করি তারা যে নারী, অর্ধেক মানুষ। কোনো বিপন্ন বিস্ময় নেই এখানে, আছে শুধু নিজের অস্তিত্বের সাথে লড়াই করতে থাকা একেকটি বিপন্ন সত্ত্বা। লড়াই করতে করতে বুঝি এতোটাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে তারা যে নিজেকে ভালোবাসাই বাদ দিয়ে দেয়। মৃত্যুর মাঝেই খুঁজে নেয় সব ক্লান্তির অবসান। হয়তো ‘লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নেই’ ‘অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল – লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।’  
তবু যারা এখনও ‘জাগিবার গাঢ় বেদনার অবিরাম – অবিরাম ভার’ সয়ে জেগে আছো তাদের বলি, জেগে থাকো, জেগে ওঠো। চিৎকার করে বলো, আমিও মানুষ। শুধু শরীরসর্বস্ব একজন মানুষ নই, মেধাসম্পন্ন একজন মানুষ। আমার শরীরের উপর অধিকার ফলাবার আগে আমার মনকে জয় করতে শেখো। আমার শরীরকে প্রাধান্য না দিয়ে মেধাকে প্রাধান্য দাও, আমার অবদানকে স্বীকৃতি দিতে শেখো। এজন্য নয় যে তোমাদের স্বীকৃতি না হলে আমার চলবে না। বরং নিজেকে মানুষ বলে যে দাবী করো সেই মনুষ্যত্বের প্রমাণস্বরূপ। 
জানিয়ে দাও পৃথিবীকে, নারীর জন্য বছরের একটি দিন রেখে নারীর গুণগান আর নারী অধিকার নিয়ে বাক্য ব্যয়ের দরকার নেই। বছরের তিনশ’ পয়ষট্টি দিনই আমার দিন। জানিয়ে দাও এই পৃথিবীটা আমারও, এখানে যেমন ইচ্ছা বাঁচার অধিকার আমারও আছে ।
অনেক তো হলো অন্যের জন্যে বাঁচা। এবার নিজেকে ভালেবাসো, নিজের জন্যে বাঁচো। যেদিন বাঁচতে শিখবে তেমনি করে, জেনো সেদিন আর প্রয়োজন হবে না তোমার জন্য আলাদা কোনো দিন। সেদিন মেয়েমানুষ থেকে তুমি হবে পূর্ণ মানুষ। সেদিন মৃত্যুর মাঝে আর তোমায় খুঁজতে হবে না মুক্তি। 
শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.