ইশরাত জাহান ঊর্মি: আমার সাথে শেষ দেখা ফরেন মিনিস্ট্রিতে। বললো, কয় মাস তোর? বললাম। বললো, শোন কয়েকটা সস্তা দেখে কাপড় কিনে কামিজ-টামিজ বানিয়ে নে। মেঘ যখন পেটে আমি তখন এরকমই কয়টা বানায়ে পরে অফিস করতাম। এরপর আর দেখা হয়নি।
মৃত মানুষদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লোকে দেখি কেবলই নিজের কথা বলে। রুনী আপার কথা বলতে গেলে আমারও তো ব্যক্তিগত কথাই আসবে। সম্পর্কটা তো ব্যক্তিগতই ছিল। না, খুব মাখামাখি বন্ধুত্ব ছিল এমন নয়। কিন্তু তবু কতদিনের একসাথে চা খাওয়া, কুটনামি, ইয়ার্কি, হাসি গান!
একবার সারাদিন একসাথে ছিলাম। যমুনা রিসোর্টে একটা নিউজ কাভারেজে গিয়ে। ফেরার পথে রুনী আপা সাগর ভাইয়ের কথা, তার ফ্যামিলির কথা, সংসারের নানা টুকিটাকি আর আমিও নতুন সংসার, স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের কথা বললাম। আর ইউএসএ তে একসাথে ২০দিন।
পথে পথে ছড়ানো স্মৃতি। রুনী আপা, রুনী আপা, কিছুতে ভুলতে পারি না তোমার মুখ। রুনী আপা আর সাগর ভাই এর মৃত্যুর পর যেখানেই গিয়েছি, কৌতুহলী মানুষ ঘিরে ধরেছে। কেন মারলো, কারা মারলো, রুনী কি পরকীয়া করতো, সরকারের ষড়যন্ত্র, না কি বিদেশী?
আমি তো ছাড়, কারো কাছেই উত্তর আছে বলে জানা নেই। সেসময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিচার চাইতে যাওয়া তার সহকর্মীদের বলেছিলেন, রুনীরা অনৈতিক জীবন যাপন করতো। তারপর ধীরে ধীরে রুনীর আপার স্মৃতির উপর রবার ঘষা হয়েছে। বঙ্গদেশে হাজারও লাশের নীচে চাপা পড়ে গেছে রুনী আর সাগরের লাশ। আমরা এসব ভুলে গেছি।।আমাদের ভুলে যাওয়ার অভ্যাস। সমাজ আর রাষ্ট্র আমাদের এই অভ্যাস সফলভাবে তৈরি করে দিয়েছে।

কিন্তু যে শিশুটার মা-বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে, সেও কি অভ্যস্ত হয়ে যাবে? রুনী আপা, তোমার মৃত্যুদিন এলেই, তোমার কাছের মানুষেরা, বন্ধু-বান্ধব, প্রিয়জনেরা গণহারে ক্ষমা চাইতে শুরু করে। ফেসবুকে লেখে, ক্ষমা করো রুনী আপা। তোমার হত্যার বিচার আমরা আনতে পারিনি। সেই বন্ধুরা যারা সারা বছর ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, যারা হত্যার বিচার করতে পারতো, তাদের সাথে সেলফি তোলা বন্ধুরা। তাদের সাথে গায়ে গায়ে ঢলে পড়ার ছবি দিয়ে যারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে, দিনের নানান কাজের ফাঁকে তারা একফাঁকে ক্ষমাও চেয়ে রাখে।
ইভেন্টের সঙ্গে যাওয়া। তুমি তো ইভেন্ট বৈ কিছু নও। আমি ক্ষমা-টমা চাই না। আমরা সেই নষ্ট, নোংরা, ভ্রষ্ট জ্ঞানপাপী রুনী আপা, যারা আসলেই তোমার হত্যার বিচার-টিচার নিয়ে ভাবি না। এভাবেই কোনদিন আমি আর আমরাও মরে যাবো, আর আমার বা আমাদের লাশও চাপা পড়ে যাবে। এই আমাদের নিয়তি এই দেশে রুনী আপা।