বিথী হক: পৃথিবীতে নারীর জন্য যে আইনগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলোতে নারীর উপস্থিতি কি ছিল? নারীর সামনে, নারীকে সামনে বসিয়ে কোন আইন প্রণয়ন করা হয়নি কেন? তাতে নারীর আপত্তি থাকতে পারে তাই? যেকোনো ভাবে নারীকে মানুষের স্তরে উন্নীত হতে দেওয়া যাবে না, এমনভাবেই আইনগুলোকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে দিয়ে পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করা হয়েছে।
ধর্মের উপর ভর করে প্রতিষ্ঠিত প্রধানত চার ধরনের আইনকে পুঁজি করে বিভিন্ন দেশের বর্তমান আইন নারীকে শোষণ করে যাচ্ছে। আর এসব আইনের বিরুদ্ধে কথা বললে সভ্য-অসভ্য সব ধরনের মানুষই নিজ নিজ মনগড়া যুক্তি নিয়ে একের পর এক আক্রমণ করে চলেছে নারীর প্রাথমিক এবং মানবিক অধিকারকে।
লেখক হুমায়ুন আজাদের বইয়ে যে আইনগুলো পেয়েছিলাম-
১. ইসলামিক বা শরীয়াহ্ আইন
২. হিন্দু আইন
৩. রোমান আইন এবং
৪. ইংরেজি সাধারণ আইন
এখন যদিও নতুন নতুন আইন প্রণীত হচ্ছে, কিন্তু সেসব আইনের কতটুকু নারীবান্ধব তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর বিতর্ক। উপরোক্ত চার ধরনের আইন দিয়ে নারীকে কিভাবে শাসন-শোষণ করা হচ্ছে তার কিছু উদাহরণ দেখি।
সম্পদ ভাগ-বাটোয়ারা, বিয়ে-তালাক, সন্তান দাবি, স্বামীর সম্পদের উপর তার অধিকার ইত্যাদি। শরীয়াহ্ আইন সরাসরি নারীকে সমাজ বিচ্ছিন্ন গৃহবন্দী প্রাণীতে রূপান্তরিত করে জোরপূর্বক তাকে সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্রের নিম্ন বুদ্ধিসম্পন্ন জড় পদার্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ধর্ম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে এতদিনে যা বুঝলাম, ধর্ম যতই স্মার্ট হোক; গোঁড়ামির দিক থেকে কেউ কারো চেয়ে কম যায় না।
সবচেয়ে বড় কথা দেশ শরীয়াহ্ আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। এখানে ব্যভিচারের শাস্তি গলা পর্যন্ত মাটির নিচে চেপে রেখে পাথর নিক্ষেপে হয় না, খুনের শাস্তি মুণ্ডুপাতে হয় না বা কথায় কথায় দোররা মারাও হয় না। আবার খুনের শাস্তি কি হবে সেটা নির্ণয়ের জন্য খুনী কোন ধর্মের সেটা জানারও প্রয়োজন হয় না। না খুন হওয়া মানুষের পক্ষে সঠিক বিচারের জন্য, না খুনী মানুষের উচিত শাস্তির জন্য!
দেশে লিখিত সংবিধান আছে, সাংবিধানিক আইন আছে। সে আইন মোতাবেক কৃতকর্মের জন্য নির্ধারিত শাস্তি আছে, যে কোন অধিকার মানুষের জন্য কতটুকু কিভাবে দিতে হবে সেটাও বর্ণিত আছে। কিন্তু যখনই নারী বিষয়ক আইনের কথা আসে তখনই ধর্মকে মাঝপথে টেনে এনে ধর্মাইনের অদ্ভূত দ্রবণ তৈরি করে মানুষকে গেলানো হয়।
দেশকে যেখানে অসাম্প্রদায়িক ঘোষণা করে লম্বা লম্বা শ্লোগান দেয়া হয়, সেখানে সব ধর্মকে আলাদা রেখে দেশভিত্তিক সর্বজনীন আইন কেন তৈরি হয় না সে বিষয়ে কারো কোন মাথা-ব্যথা নেই। কেন বিয়ে, ডিভোর্স, সম্পত্তির ভাগ-বণ্টনের জন্য সবাইকে যার যার ধর্মের উপর নির্ভর করতে হয়, সেটিও এখন পর্যন্ত উপর মহলের নাক গলানোর মতো বিষয়-বস্তুতে পরিণত হয়নি!
দেশ তো ধর্মের আইনে চলে না; না শরীয়াহ্ আইন, না হিন্দু আইন, না খ্রিস্টান আইন! ইন্টার-কাস্ট বিয়ের জন্য এখনো নারী-পুরুষকে কোর্ট-ম্যারেজের নামে বিভিন্নরকম হেনস্থার শিকার হতে হয়। যাক সেসব অন্যদিন লিখবো।
নারী ও পুরুষের জন্য বাবা-মায়ের সম্পত্তির ভাগাভাগির যে নিয়ম, তা নিয়ে এখন খুব বেশি একটা লেখালেখি করতে আমি কাউকে দেখি না। আইনের মারপ্যাঁচ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেশদ্রোহিতার শামিল পাপ না কুড়োতে যাওয়াটা একটা ভ্যালিড কারণ। আবার হতে পারে ধন-সম্পদ নিয়ে নারীদের আগ্রহ কম কিংবা হতে পারে তারা ভাইদের বেশি ভালবাসেন বলে সম্পত্তির ভাগ নিয়ে তর্কে-বিতর্কে জড়িয়ে সম্পর্ক খারাপ করতে চান না।
ঘটনা যাই হোক, সবাই যে ভাইকে একইরকম ভালবাসবেন বা সম্পদের বণ্টন নিয়ে উদাসীন হবেন, এমনটা অন্তত আমি ভাবতে পারছি না। সেহেতু ভাগাভাগি তো করতেই হবে, মুসলিম আইনানুযায়ী ছেলে এবং মেয়েকে বাবার সম্পদ ২:১ অনুপাতে ভাগ করে দিতে হবে। কিন্তু ২:১ অনুপাতে কেন? এই ধর্মই না নারীদের সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে! নাকি সম্মান দিলে সম্পদের সমান ভাগ আর লাগে না?
এই প্রসঙ্গে পুরুষতন্ত্রের কাছে শক্ত যুক্তি আছে। নারীরা তাদের স্বামীর সম্পদের ভাগও পান যেহেতু, তাই বাবা-মায়ের সম্পদ সহোদরের সমান না পেলেও এমন কিছু উল্টে যায় না। আচ্ছা তাহলে ধর্ম যেহেতু নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান দিচ্ছে, সেহেতু নারীর সম্মান রক্ষার্থে পুরুষও নারীর থেকে ভাগ পাবে। পাওয়ার কথা। তো পুরুষও যদি স্ত্রীর সম্পদের ভাগ পায়, নারীও স্বামীর সম্পদের ভাগ পায় তো ২:১ বা ১:২ কেন হবে? কেন সমান হবে না? কেন একজন নারী হলেই বাবার সম্পত্তিতে কম ভাগ দিয়ে শ্বশুরবাড়ির-স্বামীর বাড়ির সম্পত্তির ভাগ পাওয়া যায় বলে মূলা ঝুলানো?
হিন্দু আইন তো এদিক দিয়ে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে। তারা প্রয়োজনে পুত্র সন্তান দত্তক নেবেন জমির ভাগ দেওয়ার জন্য, কিন্তু কন্যা সন্তানকে ভাগ দেওয়া যাবে না। কন্যাকে পাত্রস্থ করা মাত্র মাথার টিউমার অপসারণের আনন্দ লাভ করেন। সে আনন্দকে বাড়িয়ে দিতে পণের নামে ভরি ভরি স্বর্ণ দিয়ে কন্যার শ্বশুরের চকচকে চোখ আর টাক দু’টোকেই চকচকে করে দেন। তারপর সেখানে গিয়ে চড়-থাপ্পড় যাই খাক, কন্যা পরের বাড়ির সম্পত্তি। পরের সম্পত্তির যত্ন নিয়ে কী লাভ? নিজের ঘরে পুত্রধন আছে। মরে গেলে তো সে পুত্রই মুখাগ্নি করবে, কন্যার কী হলো, তাতে কী এসে যায়? খ্রিস্টানদের জমি ভাগাভাগি আইন নিয়ে খুব একটা ওয়াকিবহাল না হওয়ায় এবং পড়াশোনা শেষ না হওয়ায় সে আইন অন্যদিনের জন্য তুলে রাখলাম।
এই হলো অসাম্প্রদায়িকতার নমুনা, ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রযন্ত্রের হাওয়াবিহীন চাকা। এখানে সম্পত্তির ভাগাভাগি করতে হলে বা ভাগ পেতে হলে সবার আগে ধর্মীয় পরিচয় লাগবে। ধর্মীয় পরিচয় না থাকলে কোন আইনে বাপ-মা’র জমিজমার ভাগ নেবেন, সেটা কখনো ভেবেছেন? কোন ধর্ম আপনাকে শান্তি দেয়, কোন ধর্মে বেশি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় এটাও বোধ হয় ভাববার সময় এসে গেছে। তা না হলে পায়ের তলায় মাটিবিহীন নারীরা সামনে অন্ধকার নিয়ে পথ হাতড়াতে হাতড়াতে গর্তে পড়ে গেলে হাততালি দেওয়ার মানুষের অভাব পড়বে না।
আশ্চর্যের বিষয় এই যে, হাততালি দেওয়া মানুষদের কাতারে আমাদের মা-বাবা, ভাই-বোন, দুলাভাই-ভাবি সকলেই আছেন। শুধুমাত্র নারীর জন্য নয়, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই দেশের একান্ত নিজস্ব আইন থাকা জরুরি। হোক সেটা বিয়ে-তালাক, জমি-জমা, সন্তান ভাগাভাগি বা অন্যকিছু।