অনুপম মাহমুদ:
আমার মেয়ের জামাই ভীষণ ভালো, ভদ্র, নম্র। এমন জামাই হয় না… আমার মেয়ে যা বলে মুখ বুঁজে তাই করে। আর আমার ছেলে, একটা হাঁদারাম, ভেড়া হয়েছে। বউয়ের কথায় উঠে আর বসে… দুই মধ্যবয়সী বাঙ্গালী নারীর কথোপকথনের একটা জনপ্রিয় কৌতুক।
কিন্তু কেন এই কৌতুক? আমার ব্যাটার বউ খুব ভালো, এটা খুব কমই শোনা যায়। বরং মেয়ে স্বামীর সংসারে কোন ঝামেলা বাধালে (মূলত কোনো পারিবারিক সমস্যার উদ্ভব হলে) সেই অভিযোগটিও শুনতে হয় মাকেই। আপনার মেয়ে আজ যা করেছে…।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আমাদের মা-খালারা বড় অসহায়! তাই নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখা বা জানান দেয়ার জন্য কিছু তো করতেই হবে, তাই না? আর তাই আমাদের বাঙ্গালী সমাজে চিরচেনা রূপ হচ্ছে বউ-শ্বাশুরী-ননদের দ্বন্দ্ব। আপনি ভুলেও শুনবেন না শ্বশুর-বউ-দেবর এর ঝামেলা, হলেও কদাচিৎ।
কেন এমন হয়? আমাদের মতো পুরুষের দৃষ্টিতে কি নারীদের দেখা সম্ভব? তাইতো যতসব বিভ্রান্তি…
বলা হয় সংসারে একসাথে থাকতে গেলে হাঁড়ি-পাতিলের মতো ঠুকাঠুকি তো হতেই পারে, ভালো কথা। কিন্তু ইদানিং আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলো হয়ে যাচ্ছে ঠুনকো কাঁচের মতোই। হাত থেকে পড়ে গেলেই ভেঙ্গে যাচ্ছে। এ যেন পান থেকে চুন খসলেই হলো, বেঁধে যাবে তুলকালাম কাণ্ড।
শহরে কী বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা। এই বিচ্ছেদের সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাবটা কিন্তু পড়ে নারীদের উপরেই। বাবা বা ভাইয়ের সংসারেই ফিরে আসতে হয়, সেই সুযোগ না থাকলে পা ফসকে অন্ধকারের চোরাবালিতেও ডুবে মরছে কত নারী।
বলা হয়ে থাকে শৈশবে পিতা, কৈশোরে ভাই, যৌবনে স্বামী আর মৃত্যুমুখে ছেলের অধীনে থাকে নারী। নারী তুমি স্বাধীন নও… একেবারে ভুল কথা নয়। আজকাল বৃদ্ধ বয়সে মায়ের স্থানটুকুও আধুনিক ফ্ল্যাট বাড়িতে হয় না, দিনে দিনে বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রম। এই সব আশ্রমে কিছু সেলিব্রেটিও যাচ্ছেন সময় কাটাতে, মিডিয়াতে নিজেকে ভিন্ন ভাবে উপস্থাপনের নেশায়।
নাম তার মুক্তা, জন্ম একটা প্রত্যান্ত গ্রামে, সম্ভ্রান্ত সৌখিন বাবার প্রথম সন্তান। স্কুলেও পাঠিয়েছিলেন, যদিও সেই সময়ে এটা ছিলো একেবারেই স্রোতের বিপরীত। পারিবারিক চাপ ও বাবার সম্মতিতে যখন বিয়ে হয় তখন তিনি চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ছিলেন, বিয়ে কী বিষয় সেটা ভালো ভাবে বোঝার কথা নয়, তাই সম্মতি দিবেন কিভাবে? একে একে পাঁচ সন্তানের জন্ম দিয়ে তাদের মানুষ করতে গিয়ে নিজেকে সময় দিতে পারেননি। তবে একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, মরে গেলেও এমএ পাস না করা অবধি কোন মেয়েকেই বিয়ে দিবেন না। তিনি কথা রেখেছেন, শত প্রতিকূলতা সত্বেও তার চার মেয়েকে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়িয়েছেন, তারপর বিয়ে। আজ তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু মা আছেন আগের মতোই। পূর্ণগৃহ আজ শূন্য… যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ান। এটাই কী তবে জীবনের জয়যাত্রা! হয়তো।
কৈশোর পেরুনো মনি, ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন এলাকার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীকে। ভেবেছিলেন তাকে মানুষ (!) করবেন ভালোবাসা দিয়ে। বাবার ঐশ্বর্য ফেলে শিক্ষকতা করে সংসার চালিয়েছেন। ছেলে ও স্বামী দুজনকেই মানুষ করার প্রাণান্তর চেষ্টা করে ছেলেকে পাইলট বানিয়েছেন। সবে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন, এই সময় স্বামী খুঁজে পেলেন তার নতুন ঠিকানা। ভালোবেসে ঘরে উঠেন আরেক নারীর। মনি পারেননি, নতুন সঙ্গিনী নিশ্চয়ই পারবেন তাকে মানুষ করতে!
সাহিদা বেগমের প্রথম বিয়েটা টিকেনি, স্বামী নেশা করে মারামারি করতো। তাই বিচ্ছেদের পর ঢাকায় আসেন, ভাইয়ের বাড়ীতে। এখানে বসে থেকে সময় নষ্ট না করে কাছেই এক বাসায় বাচ্চা দেখাশুনার কাজ নেয়। ভালোই চলছিলো। একদিন বাড়ি থেকে আসে বাবার ফোন, মেয়েকে বিয়ে দেবেন আবার। পাত্র ভালো, বিদেশে থাকেন। মেয়ে তার সুখেই থাকবেন। কিন্তু তিনি গোপন করেছেন, যে তার মেয়ের আগে একটা বিয়ে হয়েছিলো। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই ছেলের পরিবার জেনে যায় লুকোনো সত্য, তার সাথে যুক্ত হয়, মেয়ে কাজ করতো মানুষের বাসায়। লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে কীটনাশক পানে জীবনের অবসান।
দিনাজপুরের শিশু পূজা প্রতিবেশী মধ্যবয়স্কের লালসার শিকার হয়ে এখনো ভুগছে। ওর তো এখন খোলা মাঠে ধুলোবালি গাঁয়ে মেখে ছূটে বেড়ানোর কথা ছিলো। তৃষা নামের ১০ বছরের একটা শিশু গাইবান্ধায় বখাটেদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিলো সম্ভ্রম বাঁচাতে। সম্মান সে বাঁচিয়েছিল ঠিকই, শুধু জীবনটাই বাঁচাতে পারেনি এই যা।
এই তো কিছুদিন আগে বুশরা হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় হলো। ২০০০ সালে বুশরাকে নিজের ঘরে হত্যা করা হয়। আর হ্যাঁ, হত্যা করার আগে তাকে পাশবিক অত্যাচার করতে ভুল করেনি কিন্তু খুনির দল। নিম্ন আদালত ও হাইকোর্ট তিনজনকে ফাঁসি ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও চূড়ান্ত রায়ে তাদের বেকসুর খালাস দেয়া হয়। আইনের হাত অনেক লম্বা। আইন অন্ধ, আবেগ নয়, বরং আইনের সুনির্দিষ্ট ধারা ও সুগভীর তাৎপর্যপূর্ণ যুক্তিই এখানে বিবেচ্য বিষয়। তাহলে বুশরা কোথায় গেলো? তাকে কি কেউ হত্যা করেছিলো, যদি করে থাকে, তারা কারা? কিসের ভিত্তিতে আগের রায় দেয়া হয়েছিলো? এখন তবে এমন কি হলো যে পাশার দান উল্টে গেলো? আমি বুঝি না, কিচ্ছু বুঝি না।
ইদানিং হয়েছে অদ্ভুত সমস্যা। বলা উচিৎ এটা হয়তো আমার স্ত্রীর মানসিক ব্যাধি। আমাদের দুইটি সন্তান, দুজনই মেয়ে। যক্ষের ধনের মতো ওদের আগলে রাখে, কারো কোলে উঠতে দেয় না। একা বাইরে পাঠানোর তো প্রশ্নই উঠে না। আমি বড় হয়েছি খুব খোলামেলা পরিবেশে। রাজনৈতিক পবিবারের সন্তান, তাই নানা পদের মানুষের সাথে আমাদের নিত্য উঠাবসা। এই পরিবারের মেয়ে আমার, একঘরে করে মানুষ করা যাবে? এও সম্ভব?
কিন্তু যুগ পাল্টে গেছে। আমি বুঝি আমার স্ত্রীর সন্দেহ অমূলক নয়। আমি চিন্তামুক্ত নই আমার মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে। আর সরকার বাহাদুর তো সারেন্ডার করেই বলেছে কারও শোবার ঘরে পাহারা দেয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব।
কুমিল্লার তনু আর সিলেটের খাদিজা, ওদের দগদগে স্মৃতি এখনো মনে আছে। আর রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পদক পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মিতু? চট্টগ্রামে ছোট্ট ছেলেটির সামনে প্রকাশ্যে রাজপথে যিনি খুন হয়েছেন, সে তো আমরা ভুলতে বসেছি। কারণ উদ্ঘাটন এখনো হয়নি। দুর্ঘটনাক্রমে তারা সবাই নারী।
নারী তার অধিকার আদায়ের জন্য বিচার পর্যন্ত চাইবে কিনা তা বারবার ভেবে দেখে। নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলায় দীর্ঘসূত্রিতা, সামাজিক অপবাদ থেকে রক্ষা পাওয়া, বিবাদী পক্ষের আইনজীবীদের কূটচাল এবং প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে রণে ভঙ্গ দেয় নারী। আর আদালতে জিতলেও তার সংসার করা হয়ে উঠে না।
ছোটবেলায় চুল কাটাতে যা নাপিতের দোকানে যেতাম, সেখানে একটা দেয়ালে বাঁধানো একটা পোস্টারের কথা এখনো মনে আছে,
“ভাই বড় ধন
রক্তের বাঁধন
যদিও ভাঙ্গে
তাহা নারীর কারণ”
জগতে সমস্ত নষ্টের মূলেই আছে এই নারীকূল! আদি পিতা স্বর্গ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন তেমনই এক নারীর প্ররোচনায়…
তাই বুঝি নারীর প্রতি এতো ক্ষোভ, এতো রাগ? ভেঙ্গে চুরমার না করা অব্দি রক্ষে নাই। ঘরেবাইরে সর্বত্র তোমার নিরাপত্তা নিয়ে এতো শঙ্কা কেন? নারী তুমি আসলে তোমার নও। তোমাকে হাঁটতে হবে সময়ের সাথে পা মিলিয়ে… এই সময়টা যদি কখনও তোমার পক্ষে নাও থাকে নারী।
শরিফা ইয়াসমিন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোড় খাওয়া শিক্ষক, যিনি বাসে নারীর জন্য আসন সংরক্ষণ থেকে শুরু করে, চাকুরী, সংসদের এমপি সব কিছুকেই দেখেন নারীকে আটকে রাখার অস্ত্র হিসেবে। তিনি বিশ্বাস করেন, নারীর যোগ্যতা থাকলে তা সে অর্জন করবেই, তার জন্য প্রয়োজন প্রতিযোগিতায় নিজেকে যোগ্য করে তোলা, তা না হলে এই দুষ্টচক্রের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পাবে না তুমি…
অনুপম মাহমুদ, উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭