রিয়াজুল হক: জ্যাকুলিন মিথিলাকে আমি চিনতাম না। তার সম্পর্কে আমি জানতামও না। আজকে একটি সংবাদপত্রে পরিবেশিত খবরে তার সম্পর্কে প্রথম জানলাম। কিন্তু সেই খবরটি অনেক কষ্টের। অনেক দুঃখের। মিথিলা আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু যুববয়সের একটি মেয়ে কেন নিজেকে হনন করবেন? এই সময়ে তো তার নিজের জীবন তৈরি করার কথা। তার নিজের জীবন বিনাশ করার কথা নয়। সেটি আমার কাছে অনেক বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
২.
এরপর আমি তার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। তার নাম লিখে ইন্টারনেটে সার্চ দেই। তথ্য ঘেঁটে আমি তার যাপিত জীবনকে বোঝার চেষ্টা করি। প্রাপ্ত তথ্যে দেখি, তিনি ছিলেন ‘সেলিব্রেটি’। অর্থাৎ তাকে ঘিরে ছিল ‘সেলিব্রেসন’। কিন্তু সেই ‘সেলিব্রেসনে’ কী আছে’? কী তার উপাদান বা কনটেন্ট? দেখলাম, সেখানে আছে যৌনতা। কিন্তু যৌনতা তো জীবনেরই অংশ। সে হিসেবে যৌনতা যদি কোনো গণমাধ্যমে আসে, শিল্পে আসে, তাতে ক্ষতি কী? কিন্তু মিথিলাকে ঘিরে সমাজের মানুষের যে ‘সেলিব্রেসন’, তাতে যৌনতা জীবনের অংশ হিসেবে আসেনি। যৌনতার আবেগীয় ও মানবিক দিকটাকে উপেক্ষা করে এখানে প্রধান হয়ে গিয়েছিল মিথিলার শরীরটাকে ‘অবেজেকটিফাই’ করা। শরীরকে ঘিরে অজস্র পুরুষের কামনা তৈরি করা।
৩.
পুরুষতন্ত্র নারীর শরীরকে অবজেকটিফাই করে পুরুষের কাছে। পুরুষতন্ত্র নারীর শরীরকে পুরুষের কাছে ভোগের বস্তু বানায়। নারীকে ভোগের বস্তু হিসেবে দেখতে পুরুষকে শেখায়, উদ্দীপ্ত করে। পুরুষতন্ত্র নারীকেও প্রণোদিত করে নিজেকে ভোগের বস্তু হিসেবে দেখতে, মেনে নিতে এবং উপস্থাপন করতে। এ যেন চাহিদা ও যোগানেরে এক মিলনমেলা, পুরুষতন্ত্র যার মনস্তাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক উপযোগিতা তৈরি করে।
৪.
পুরুষতন্ত্রই শুধু নারীর শরীরকে অবজেকটিফাই করেই ক্ষান্ত হয় না। অবজেকটিফাইড নারীর ভূমিকাও নির্ধারণ করে দেয়। যৌনতার ক্ষেত্রে কেবল পুরুষের ইচ্ছের কাছে সাড়া দেয়াই হবে নারীর কাজ। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, তাড়না-প্রয়োজন, এমনকি তার জীবন এসব এখানে গ্রাহ্য নয়। অনেকটাই প্রকৃতির মতো। শুধু সাড়া দেবে ভোগের সব উপাদান যোগানোর জন্য। স্পন্দিত হবে পুরুষের কাম নিবারণে সকল উদ্দীপনা তৈরির জন্য। যার পরিণতি হবে পুরুষের তৃপ্তি বা সন্তুষ্টি, এবং তা সর্বোচ্চ মাত্রায়।
৫.
পুরুষতন্ত্র নারীর শরীরকে পুরুষের কাছে অবজেকটিফাই করে। আর পুঁজিতন্ত্র নারীর সেই অবেজেকটিফাইড শরীরকে বাজারে নিয়ে আসে। নারীর শরীরকে বাজারে নিয়ে আসে পণ্য হিসেবে। পুঁজির লক্ষ্য হলো মুনাফা। প্রথমত মুনাফা, দ্বিতীয়ত মুনাফা এবং শেষ অবধি মুনাফা। সেখানে মানবিকতা-আবেগ, স্বাধীনতা, ভালবাসা, ডিগনিটি এসবের কোনো মূল্য নেই। যতো ভোগ ততো পণ্যের চাহিদা। যতো পণ্যের চাহিদা ততো মুনাফা। সেখানে বরং লক্ষ্য নারীর শরীরকে পুরুষের গণভোগের সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ে যাওয়া।
৬.
কিন্তু একটি অবজেকটিফাইড শরীর, আর তার একজন মাত্র পুরুষভোক্তা– এ দিয়ে পুঁজির বর্ধিত ও বিস্তৃত মুনাফা সম্ভব নয়। তাই পুঁজিতন্ত্র একাধিক পুরুষভোক্তা তৈরি করে। এক নারীর অবজেকটিফাইড শরীরকে পাওয়ার জন্য লক্ষ্য পুরুষের মাঝে এক ‘অনুভূত চাহিদা’ তৈরি করে। গণমাধ্যম এবং নতুন যুগের মাধ্যম তখন বেশ কাজে লাগে অজস্র পুরুষের মাঝে এক নারীর শরীরকে পাওয়ার তার প্রকাশভঙ্গি দেখার ‘অনুভূত চাহিদা’ তৈরির জন্য।
৭.
শুধু অলোকচিত্রে বা সেলুলয়েডে নারীর অবেজেকটিফাইড শরীরকে উপস্থাপন করা নয়। এখন একজন নারীর শরীরকে একই সময়ে ‘লাইভ প্রেজেন্ট’ করা যায় লক্ষ লক্ষ পুরুষের কাছে। এটি হলো ইন্টারএকটিভ প্রসেস। সেলুলয়েডে অবজেকটিফাইড নারী সাড়া দেয় নির্দেশকের নির্দেশে বাজারের তাগিদে। কিন্তু ভোক্তার সাথে তার সরাসরি কোনো ইন্টারঅ্যাকশন নেই। কিন্তু লাইভ স্ট্রিমিংয়ে অবজেটিফাইড নারী সাড়া দিচ্ছে সরাসরি পুরুষভোক্তার কামাতুর আহ্বানে, প্রশ্নে, সংলাপে এবং শরীরের প্রকাশভঙ্গিতে। এ হলো এক নতুন উপায়, নতুন আকর্ষণ, এক নতুন জোশ।
৮.
কিন্তু যে নারী অবজেকটিফাইড হয়, যে নারীর শরীর বা যৌনতার প্রকাশভঙ্গি বাজারের পণ্য হয়ে যায়, যে নারীকে ‘সেলিব্রিটি’ হিসেবে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ পুরুষভোক্তার কামাতুর আহ্বান, প্রশ্ন, সংলাপ, প্রদর্শন নামক ‘সেলিব্রেসনে’ সাড়া দিতে হয়-ক্রমান্বয়ে সে আবিষ্কার করে তার শরীরের মালিক সে নিজে নয়। তার নিজের শরীর তার নিজের তাড়না, তার নিজের প্রয়োজন, তার নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অধীন নয়। তার শরীরের সাথে তার নিজের ভাল লাগা, তার নিজের আবেগ, তার নিজের ভালবাসা যুক্ত নয়। তার শরীরের দখল নিয়ে গেছে অন্য অনেক পুরষ। তার শরীরের দখল নিয়ে গেছে ‘মুক্তবাজার’। তার শরীরের মালিক বনে গেছে লক্ষ লক্ষ ভোক্তাপুরুষ। সে অনুভব করে তাকে ঘিরে অনেক কামাতুর পুরুষ আছে। কিন্তু এরা শুধু তার শরীর চায়, তার যৌনতার প্রকাশভঙ্গী উপভোগ করতে চায়। এরা কেউ তার জীবনের প্রতি সমানুভূতিশীল নয়, শ্রদ্ধাশীল নয়। এ ভাবনা একজন মানুষের মধ্যে তৈরি করে এক ধরনের ‘বিচ্ছিন্নতা’।

৯.
এ ‘বিচ্ছিন্নতা’ প্রথমে তৈরি হয় নিজের মনের সাথে নিজের শরীরের। নিজের সাথে নিজের পরিবার-পরিজনদের। সর্বপরি নিজের সাথে সমাজের। এ ‘বিচ্ছিন্নতা’ তখন বেঁচে থাকার আনন্দকে পিষে মেরে ফেলে। জীবনকে বিকশিত করার স্বপ্নকে বিনষ্ট করে। নিজের জীবনকে অপ্রয়োজনীয় ভাবতে শেখায়। সে ডুবে যায় গভীর হতাশায়-কষ্টে-বেদনায়। নিজেকে তখন সে তৈরি করে আত্মহননে।
১০.
আত্মহননের শিকার জ্যাকুলিন মিথিলার বেলায় তাই হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে এটি একটি আত্মহত্যা, যদি কোনো ব্যক্তি তাকে সরসরি হত্যা করে না থাকে। আর যদি সত্যি এটি আত্মহত্যা হয়ে থাকে, তবে তার আত্মহনন ঘটেছে এক সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বোধ থেকে। যে বিচ্ছিন্নতাবোধ তার মাঝে তৈরি করেছে পুরুষতন্ত্র ও পুঁজিতন্ত্র। প্রকারান্তরে পুরুষতন্ত্র ও পুঁজিতন্ত্রই তার ঘাতক। মিথিলার প্রতি আমার কোনো অনুযোগ নেই। তার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার সকল অনুযোগ, অভিযোগ পুরুষতন্ত্র ও পুঁজিতন্ত্র-এর প্রতি। মিথিলা তুমি অনেক ভাল থেকো।