আকতার বানু আলপনা: মানুষ লেখালেখি করে প্রধানতঃ পাঁচটি কারণে-
১. মানুষ লেখে মূলত: মনের আনন্দে। তার নিজের ভাবনা, অনুভূতি প্রকাশ করতে ভাল লাগে, তাই লেখে,
২. লেখা পড়ে মানুষ অনেক কিছু জানবে, জ্ঞান. বাড়বে, উপকার হবে, সমাজ, রাষ্ট্র, তথা জীবনের নানা অসংগতি সম্পর্কে জানবে, সচেতন হবে তাই লেখে,
৩. লেখা পড়ে মানুষের চিন্তাভাবনা, মানসিকতা, ধারণা, আচরণ পরিবর্তন হবে। এভাবে ধীরে ধীরে সমাজ পরিবর্তন হবে সেজন্য লেখে,
৪. পাঠককে নির্মল আনন্দদানের জন্য লেখে, সুখ-দুঃখের নানা ঘটনা, চরিত্রের মাধ্যমে সমাজের নানা বিষয় তুলে ধরে মানুষকে বিনোদন দেবার জন্য লেখে,
৫. কেউ কেউ লেখে বিখ্যাত হওয়ার বা অর্থ উপার্জনের জন্য।
আমি নিজে কেন লিখি? লিখে কি লাভ?
যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁরা জানেন, লেখার কাজটা সহজ নয়। হলে সবাই লিখতেন। আবার অনেকের লেখার হাত, ক্ষমতা বা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও লেখেন না। এটা অন্যায়। মহা অন্যায়। সৃষ্টিকর্তার দেয়া ক্ষমতার অপচয় করা পাপ। তাই আমার মনে হয়, যাঁরা লিখতে পারেন, তাঁরা লিখুন। অনুপ্রেরণা না পাওয়া, ব্যস্ততা, কেউ পড়বে না, সমালোচনা করবে, বাধা দেবে… ইত্যাদি কোন অজুহাতেই লেখা বন্ধ করা উচিত নয়।
এবার আসি লেখার মান প্রসংগে। সবার লেখার মান সমান নয়। সবার লেখা সবার ভাল লাগবে না। না লাগাটাই স্বাভাবিক।কারণ সবার মন-মানসিকতা, পরিবেশ, পছন্দ, মূল্যবোধ, বিশ্বাস… ইত্যাদি আলাদা। কারণ প্রতিটা মানুষই ইউনিক। কেউ কারো মত নয়। আমাদের মানসিকতার অল্প কিছু জিনিস অন্যের সাথে মেলে। এজন্যই জীবন বৈচিত্র্যময়। সবাই সবকিছু একই দৃষ্টিতে দেখলে জীবন একঘেঁয়ে হয়ে যেত।
সব মানুষের সব রকমের অভিজ্ঞতা হবার সুযোগ নেই। সবার জীবনে সবকিছু ঘটে না। যেমন আমার এক পাঠক আমি কাউন্সেলিং করি জেনে আমাকে তাঁর মানসিক কষ্টের কথা জানিয়ে সমাধান চেয়েছেন। ছোটবেলায় তাঁর বাবা খুন হয়েছিলেন। সে খুন করিয়েছিলেন তাঁর আপন দাদী। ১৪/১৫ বছর বয়সে এটা জানার পর থেকে তিনি মানসিক কষ্টে ভুগছেন। এমন অভিজ্ঞতা সবার হবে না। কিন্তু তিনি যদি লেখেন বা বলেন, তাহলে আমরা অন্যরকম একটি অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানার সুযোগ পাবো।
এ প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের ছেলে নুহাশের লেখা আমি পড়েছি। এতো আপন যে বাবা, দ্বিতীয় বিয়ে করার পর কীভাবে একটু একটু করে সেই বাবাই পর হয়ে যায়, তার কষ্টকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা আছে তার লেখায়।
তাই প্রতিটা মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিখতে পারি। সেই অভিজ্ঞতা জানার উপায় হলো লেখা। লেখা সময়কে ধরে রাখে। আমি আজ যা লিখছি, তা বর্তমান। আবার এই লেখাই অনেকদিন পরে অতীতেের মূল্যবান দলিল বলে বিবেচিত হবে। বিভিন্ন অতীত ইতিহাসের স্বর্ণালী দিনগুলো আমাদের সামনে জীবন্ত হয় লেখা, ছবি, সিনেমা-নাটক, ডকুমেন্টারি ইত্যাদির মাধ্যমে।
আমি লিখি দেখার জন্য যে আমি বিষয়গুলোকে যেভাবে দেখি, অন্যরা সেভাবে দেখে কিনা তা জানার জন্য। আমি যেভাবে বলছি, আমার লেখা পড়ার পর মানুষ নতুন করে ভাবুক সেটা ঠিক বলছি কিনা। অর্থাৎ চিন্তার খোরাক জোগানোর জন্য। নতুন করে ভাবার জন্য।
হুমায়ূন আহমেদ যদি শুধু শিক্ষকতা করে জীবন পার করে দিতেন, তাতে তাঁর তেমন কোন ক্ষতি ছিল না। দিব্বি খেয়ে-দেয়ে, হেসে-খেলে জীবন পার করে দিতে পারতেন। এতে তাঁর ক্ষতি না হলেও আমাদের বিশাল ক্ষতি হয়ে যেত। তাঁর হাত দিয়ে আমরা যা পেয়েছি, সেই দুর্লভ অবদান থেকে এদেশের মানুষ বঞ্চিত হতো। তাঁর মৃত্যুর হাজার হাজার বছর পরেও এদেশের মানুষ শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতাভরে তাঁকে স্মরণ করবে তার কাজের জন্যই। স্বল্প জীবনে এ পাওয়া কম নয়।
আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই খুব ভাল লেখেন, নানা বিষয়ে গবেষণা করেন যাঁর যাঁর নিজস্ব ক্ষেত্রে। আমার পরিচিত আরো অনেকেই লেখেন নানা বিষয় ও সাহিত্যের নানা দিক থেকে। তাঁদের সবার লেখাই আমি কম-বেশী পড়ি। পাশাপাশি অবাক হই, হতাশ হই এটা দেখে যে, এই লেখকদের মাঝে লেখিকার সংখ্যা খুবই কম। অথচ আমি জানি, চাইলে তাঁরা অনেকেই ভালো লিখবেন।
মেয়েদের লেখালেখি করা উচিত। সবার ভাবনা অনুভূতি আলাদা। মেয়েরা মেয়েদের মনের কথা যেভাবে বলতে পারে, ছেলেরা সেটা পারে না।
আমার আজকের লেখা তাঁদের উদ্দেশ্যে যাঁরা পারেন, অথচ লেখেন না। আমার অনুরোধ, অল্প করে হলেও কিছু লিখুন। যেমনই হোক। লিখতে লিখতে হাত পাকা হবে। এমন অনেক বিষয় সামনে চলে আসবে যেগুলো নিয়ে লেখা জরুরী।
আমার লেখা পড়ার পর যদি একজন লেখকও তৈরি হয়, আমার লেখা সার্থক হয়েছে বলে ধরে নেবো।
খুব খুব ভাল থাকবেন বন্ধুরা…