তামান্না কদর: জ্যাকুলিন নামে কোনো একটি মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। আমি তার আত্মহত্যাটিকে কেবল একজন মানুষের আত্মহত্যা হিসেবেই অনুধাবন করতে যদি পারতাম তাহলে অতো বেশি যন্ত্রণা পেতাম না। তার মৃত্যুতে উল্লাসীর সংখ্যাই বেশি। কেনো বেশি? কারণ সে নারীলিঙ্গ নিয়ে জন্মেছিলো এবং তার কাজের ধরন।
আত্মহত্যা নিঃসন্দেহে একটি কঠিন দুধর্ষ কাজ। একটা মানুষ কতোটা অসহায় হলে নিজেকে নিজে মেরে ফেলার মতো সাহস করেন এ কেবল আত্মহত্যাকারীই জানেন।
জ্যাকুলিন কি একা হয়ে গিয়েছিলেন? কারোরই বুকের ওমযুক্ত ভালোবাসা পাননি? তিনি কি বদনামের শিকার হয়েছিলেন? কেউ কি তাকে তার কাজের জন্যে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলো?
একটি মানুষের মৃত্যুই তার নিজের জন্যে শেষ কথা। জ্যাকুলিনের মৃত্যুতে উল্লাস এবং তার প্রতি ঘৃণাপোষণ দেখে অবাক হচ্ছি না, তীব্র ক্ষোভ হচ্ছে। জ্যাকুলিন কি ধর্ষক ছিলো, খুনি অথবা মানব অহিতকর কোনো কাজ করতো? সেসবের জন্যেই কি তার মুত্যুতে এমন প্রতিক্রিয়া?
জ্যাকুলিন নাকি ন্যুড পিক আপলোড করতো, তারপর মডেল হলো। খ্যাতি পাবার এই যে স্রোতধারা এটা কার বা কাদের তৈরি? যে কাজের জন্যে জ্যাকুলিনের মর্মান্তিক মুত্যুর পর যারা উল্লাস আর ঘৃণায় মত্ত রয়েছে, তারা জ্যাকুলিনের সে কাজ দেখে কতোটা পুলক অর্জন করেছে, তারা তা নিশ্চয়ই জানে।
কী অসম্ভব বৈপরীত্য! কী স্ববিরোধিতা! জ্যাকুলিন যা করতো তার চাহিদা ব্যাপক ছিলো। বাজারভর্তি ভোক্তা ছিলো। চাহিদা আর ভোক্তার যোগান থাকলে যেকোনো জিনিসই বিকোয় ভালো। ‘সানি লিওন’ বা ‘রেশমী’ বলে গাল দেয়া ছেলেটিও সানি বা রেশমির কাজ না দেখে রাতের ঘুম আরাম করতে পারে না এমন সংখ্যা তো ব্যাপক।
পুঁজির বাজারে পুরুষ যখন একচ্ছত্র ক্রেতা, তখন নারী খুব খুব অসহায় অবস্থানে থাকে, আর স্বয়ং নারী যখন তার শরীর এবং সৌন্দর্য বিকোবার ইন্ধন এবং ক্ষেত্র পায় তখন সে নিজের সৌন্দর্য ও শরীর বিক্রি করে অর্থকড়ি কিছু পায় কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে চরম মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
বেশ্যার একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে। সে সংজ্ঞানুযায়ী মানবসমাজে কালিমার যে আবহ তৈরি করা হয়েছে তাতে পুরুষের কিছু যায় আসে না, কালিমাটা নারীর জীবনেই জুটে। অর্থ হলো ঈশ্বর। ঈশ্বরের বিরোধিতা করে এমন সাহস কজনের আছে! এই ঈশ্বরের মালিক পুরুষ , ক্রয় করে নারীর সৌন্দর্য ও শরীর।
মানবিক দৃষ্টিকোণ্ থেকে ক্রেতার জীবনটা কালিমাযুক্ত হওয়া উচিত ছিলো, কেননা মানুষ হয়ে মানুষ কিনতে চাওয়ার মানসিকতাটাই বাজে, ইতর, অসভ্য। শ্রমদাস কিনতে চাওয়া যেমন অসভ্যতার, অমানবিক তেমনি যৌনদাস কিনতে চাওয়াও অসভ্যতার, অমানবিক। এই বোধটুকু যতোদিন না পর্যন্ত আমাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ততোদিন পর্যন্ত নিজেদের মানবিক এবং সভ্য বলে দাবি করাটা অপরাধ।
জ্যাকুলিন তার সৌন্দর্যকে পুঁজি করেছিলেন, আসলে ক্ষেত্র আছে সৌন্দর্যকে পুঁজি বানাবার। আমরা সকলে সে ক্ষেত্রকে কাজে লাগাই না, কেউ কেই লাগাই। সেই কেউ কেউ যখন আমাদের সৌন্দর্য কিনবে, বিমোহিত হবে, পুলক অর্জন করবে, তারপর গালি দিবে খানকি মাগি, আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করি। আমাদের এমনতরো আক্ষেপের, যন্ত্রণার মৃত্যুর পর বলবে, তোর এভাবেই মরা উচিত হয়েছে শালী। ওরকম অনুভবের উক্তির প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করি।