শান্তা মারিয়া: লেখাটা শুরু করার আগেই একটা ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস আমাকে আচ্ছন্ন করলো। জ্যাকুলিন মিথিলার আত্মহত্যার খবরটা দেখলাম। তার সম্পর্কে ফেসবুকে মন্তব্যগুলো পড়লাম। তার মৃত্যুর খবরের মধ্যেও আছে যে সে খোলামেলা ছবি পোস্ট করতো।
জ্যাকুলিন কি কেবলই ‘রমণী’ ছিল? শুধুই রমণযোগ্য বা লোভনীয় একটা নারীর দেহ? সেকি আফ্রোদিতি বা উর্বশীর মতো পূর্ণ যৌবনা হয়ে পুরুষের কামনার সমুদ্র থেকে উঠে এসেছিল? ‘যখনি জাগিলে বিশ্বে যৌবনে গঠিতা, পূর্ণ প্রস্ফুটিতা’’ তার কি কোনো শৈশব ছিল না? শুধুই কামার্ত পুরুষের অঙ্কশায়িনী হওয়ার প্রলোভন দেখাতো সে? সে কখনও বাবার কোলে ওঠেনি শৈশবে? ভায়ের হাত ধরেনি? কখনও কোনো ছোট ছেলের চেহারায় নিজের অনাগত সন্তানকে কল্পনা করেনি? কিংবা নারীর পারিবারিক ভূমিকার বাইরে কখনও ভোরের আলো দেখে তার হাত বাড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করেনি একজন মানুষের মতো? জ্যোৎস্না দেখে ভালোবাসতে ইচ্ছ হয়নি রাতকে? সে কখনও মানুষ হতে চায়নি? কবিতা পড়েনি? স্বাধীন, মুক্ত, যৌনপরিচয়ের উর্ধে যে মানুষ, জ্যাকুলিন কি কখনও সেই মানুষ ছিল না?
আমি সেই ‘মানুষ জ্যাকুলিন’এর মৃত্যুতে শোক অনুভব করছি। শোক অনুভব করছি সেই মানুষটির জন্য যাকে মানুষ হয়ে বাঁচতে দেয়নি পুরুষতন্ত্র। যাকে তারা ‘সেক্স ডল’ হতে উৎসাহিত করেছে।
সব মানুষই ‘বিশিষ্ট’ হতে চায়। চারপাশের মানুষের মনোযোগ চায়, ভালোবাসা চায়। কেউ মেধা, কেউ পরিশ্রম, কেউ ধনদৌলত, কেউ পারিবারিক পরিচয়, আবার কেউ নিজের শরীর দিয়ে পরিচিতি চায়। এই বিশ্বে যে নারীরা ‘পুরুষের সেক্সডল’ হয়ে বিশিষ্ট হতে চায় মানুষ হিসেবে তারা বড় নিঃসঙ্গ। পুরুষতান্ত্রিক শিক্ষা ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজই তাকে ওইভাবে গড়ে তোলে। প্রাচীন ভারতবর্ষে ‘গৃহাঙ্গনা’ ও ‘বারাঙ্গনা’ এই দুইভাগে নারীকে ভাগ করে ফেলা হতো। একজনকে গৃহকর্মে শিক্ষা দেওয়া হতো। সে হতো স্ত্রী। শুধু একজন পুরুষের ভোগ্য ও সন্তানের জন্মদাত্রী। আরেক জনকে দেওয়া হতো নৃত্য, গীতের শিক্ষা। শেখানো হতো কামসূত্র। সে হতো লীলাময়ী, নটী। বহুজনের ভোগ্য। এইসব বাধা ঠেলেও অবশ্য গার্গী, মৈত্রেয়ী, লীলাবতী, খনা, চন্দ্রাবতীরা মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
এযুগেও কোনো কোনো নারীকে পরোক্ষ উৎসাহ দেওয়া হয় ‘পর্নস্টার’ হওয়ার জন্য। যখন সে ‘আইটেম গার্ল’ হয় তখন তার মনুষ্যত্ব যেন হারিয়ে যায় তার যৌন খ্যাতির আড়ালে। মেরিলিন মনরো, জিনা লো লো ব্রিজিতা, রিটা হাওয়ার্ডরা একালের মৃচ্ছকটিকের নায়িকা, তারা পুরুষের বাসবদত্তা। মেরিলিন মনরোর যৌন আবেদন নিয়ে কত কথা। অথচ তিনি যে সুঅভিনেত্রী ছিলেন, ভালোবেসেছিলেন জন কেনেডিকে অন্তর থেকে, সে কথা কিন্তু আড়ালেই থেকে গেছে।
জ্যাকুলিনের আত্মহত্যার পরও তার মৃত্যুর খবরে সেই যৌন আবেদনময়ী ‘রমণী’র কথাই আলোচিত হচ্ছে। মৃত্যু হলো কোনো বাবা মায়ের আদরের মেয়েটির, ভাইয়ের বোনটির, বন্ধুদের কাছে প্রাণোচ্ছল সঙ্গীর কিংবা বিশ্ববিধাতার আদরের সৃষ্টি আবেগময় মানুষটির সে কথা অনুচ্চারিতই রয়ে গেল।

আমি শোক করছি সেই মানুষটির জন্য। যেকোনো মানুষের মৃত্যুই বেদনার। আর যদি তা হয় অভিমানে, তাহলে আরও কষ্ট হয়। জ্যাকুলিন লিখেছে ‘সে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। কিন্তু এখন তার প্রিয় মানুষটির প্রেম কমে গেছে।’ মেয়েটি বেঁচে থাকলে তাকে বলতাম, কেন রে মেয়ে? যে তোকে ভালোবাসে না তার জন্য কিসের এতো অভিমান? তার মতো আরও যারা আছে তারা বেঁচে থাকতেই তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, জাগো মেয়ে। তুমি কি কেবলই শরীর?
বাঁচো। নিজের মতো করে বাঁচো। মানুষের মতো করে বাঁচো। তোমার যৌনতা, তোমার নিজের জন্যই, তোমার জীবনকে উপভোগের জন্য। আর যে তোমাকে ভালোবাসে না তার উপর অভিমান করো না। যে তোমাকে মানুষ হিসেবে সম্মান করে তাকে ভালোবাসো। তেমন কেউ না থাকলে ভালোবাসো নিজেকেই। ভালোবাসো এ বিশ্বকে। ‘আকাশ ভরা সূর্যতারা, বিশ্ব ভরা প্রাণ।’ এখানে তোমার আপন স্থানটি খুঁজে নাও, গড়ে নাও। মানুষ হিসেবে।