লিটন চন্দ্র ভৌমিক: দেখলাম একজন মডেল আত্মহত্যা করেছে। কয়েকদিন পরপর এসব নিউজ দেখি। মডেল, আত্মহত্যা এসবের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই; কিন্তু তীব্র আগ্রহ গোড়ার কারণটির প্রতি।
হলিউড হাব লস এঞ্জেলেসে দিনরাত প্রতিযোগিতা হয়: ‘Miss America’, ‘Queen USA Pageant’, ‘Dream Girl USA’, ‘Miss Teen Fashion’ … …. সুবিশাল অর্থনীতি হওয়াতে কর্পোরেট কোর আমেরিকা বিপুল প্রতিযোগীকে গিলতে পারে। কিন্তু হতাশদের আত্মহত্যা থামাতে পারে না।
এরপর বড় প্রতিযোগিতা বলিউড হাব মুম্বাইতে হয়। অজস্র সেলিব্রেটি শো, রিয়েলিটি শো, ফ্যাশন শো; যারা তুমুল প্রতিযোগিতা, লিংক-লবিং, গ্ল্যামার্স- হার্ডওয়ার্ক পেরিয়ে পৌঁছায় আমরা তাদের দেখি। মুম্বাইও খুব বেশি গিলতে পারে না; কয়েকদিন পরপর নিজ ফ্ল্যাটে আত্মহত্যা করে প্রতিযোগীরা। শোবিজের রঙিন জগৎ আর বাস্তবের সাদাকালো দুনিয়ার সাথে মিলাতে পারে না অনেকেই।
আমাদের ফিল্ম-সংগীত-নাচ কোনোটার ভালো বাজার নেই, কিন্তু কয়েকদিন পরপর প্রতিযোগিতা আছে। ‘দারুচিনি দ্বীপ’ এর নায়িকারা; ‘ক্লোজ আপ ওয়ান’, ‘সেরা কণ্ঠ’, ‘পাওয়ার ভয়েস’ এর গায়িকারা কোথায় হারিয়ে গেলো, ‘মডেল হান্ট’ ‘বাংলাদেশ আইডল’ প্রতিযোগিতা’র মডেলরা এখন বোধহয় শুধু প্রোপিক পাল্টায়, ‘নাচো বাংলাদেশ নাচো’ প্রোগ্রামের প্রতিযোগীরা কোথায় নাচছে কে জানে!
এই প্রতিযোগিতার মালিকদের কারও উদ্দেশ্য কিন্তু ফিল্ম, সংগীতের বাজার তৈরি করা না; ফিল্ম সংগীতকে উপরে নিয়ে যাওয়া না; যে যার ব্যবসা করে পগারপার। মোবাইল কোম্পানিগুলোও একটুখানি এসএমএস ব্যবসা করে। মাঝখানে ডায়াসে রঙিন আলোতে কয়েকদিন ‘ধামাকা’ ‘হুররে’ ‘উলালা উলালা’ স্বরে গান গাওয়া গায়ক-গায়িকারা প্রতিযোগিতা শেষে অন্ধকার দেখে।
মডেলরা ২/১ টা প্রোগ্রামে শারীরিক কসরত দেখিয়ে এরপর মানসিক কসরতে ভোগে। আপিয়ার হওয়ার সাথে সাথে ডিসআপিয়ার হয়ে যায় ৯৫ ভাগ প্রতিযোগীরা। অনেকাংশে এই জেনারেশনকে বানানো হয় রসায়নের রেডিয়াম, থোরিয়াম, ইউরেনিয়াম মৌলের মতো; তেজস্ক্রিয় উত্থান এরপর নিষ্ক্রিয় হারিয়ে যাওয়া।

এই যে মডেলটি আত্মহত্যা করলো, চাকরি না পেয়ে যে যুবকটি গলায় দড়ি দিলো, গোড়ার সূত্রটি একই। অর্থনীতির ছোট্ট সূত্র- চাহিদার সাথে যোগানের সমতা থাকতে হবে। স্বপ্ন দেখার সাথে সাথে স্বপ্নের প্লেসমেন্টও থাকতে হবে। কিন্তু যে পরিমান স্বপ্ন দেখানোর শিব খেরা তৈরী হয়, সে পরিমাণ নিয়োগ দেয়ার উদ্যোক্তা তৈরি হয় না।
চারপাশের অস্থিরতা, ভয়ংকর টানাপোড়েন আবার যেকোনোভাবে নিজেকে আলোচিত, আলোড়িত, মুখরিত করে তোলার বিশাল চেষ্টা তরুণদের। ‘জনপ্রিয়’ হতে চাওয়া, শর্টকার্টে ‘সেলিব্রিটি’ হতে চাওয়া এইসময়ের বিশাল একটা রোগ।
ইউরোপ আমেরিকার নিভৃতচারী কিছু গবেষকের সাথে আড্ডা হয়। এই বিশাল মানুষগুলোর ফিলোসফি- ‘পৃথিবীর সুবিশাল মানবজাতির আমি একটা অংশ; আমার অর্জিত দক্ষতা-জ্ঞান-শিক্ষা দিয়ে কেবল আমার কাজটুকু করে যাওয়াটাই আমার দায়িত্ত্ব’।
আমাদের একটা জেনারেশনের ফিলোসফি- ‘সবাইকে মাড়িয়ে- ছাড়িয়ে- নাড়িয়ে একটা কিছু দেখাবো; ফাটিয়ে- কাঁপিয়ে দেব শালা; সবাই আমাকে জপবে’।