শারমিন জান্নাত ভুট্টো: ফেব্রুয়ারি মাস মানে ভাষার মাস, আর এ মাস এলেই আমাদের মাঝে কম-বেশী ভাষাপ্রেম জাগ্রত হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে যে যেভাবেই সম্মান দেখাক আমার কোনো আপত্তি নেই, বা থাকার কথাও না। দিনশেষে আমরা যাতে একই দিকে ধাবিত হই, সেটাই মূল লক্ষ্য।
এখন যে কারণে আজকের এই লেখা তা হচ্ছে- আমরা আমাদের দেশের ইদানিংকালের নাটকে বাংলা ভাষার যে ব্যবহার দেখছি তা কি আদৌ আমাদের দেশীয় ভাষা?

দেশে বাংলা ও ইংরেজী মাধ্যমের দরুণ একটি প্রজন্ম দুইভাবে বড় হচ্ছে। তবে আমি এতে খারাপ দেখছি না। বাংলার পাশাপাশি অবশ্যই ইংরেজী জানার প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। বিশেষ করে বিলেতে পড়তে এসে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বিলেতে অনেক বাঙালী আছেন যারা দুর্দান্ত পরিশ্রমী তাদের কর্মক্ষেত্রে, কিন্তু একটি জায়গায় পিছিয়ে আছেন। আর তা হলো ইংরেজীতে অনর্গল কথা বলায়। দেখা যায়, তারা সহকর্মীর সব কথাই বুঝতে পারছেন, কিন্তু উত্তরে ঠিকমতো বলতে পারছেন না।
আইইএলটিএস এর কারণে বিলেতি বাঙালী বন্ধুরা Listening এ ভালো, কিন্তু Speaking এ খানিকটা দুর্বল। এ অবস্থাকে আমরা অনেকেই মজা করে বলি- ইনকামিং ঠিক আছে, তবে আউটগোয়িং এ সমস্যা। তবে দিনকে দিন এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন অনেকেই বিভিন্ন ধরনের ইংলিশ কোর্স ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে।
যাকগে সে কথা। মূল আলোচনায় ফেরা যাক। বলছিলাম বাংলা নাটকে ভাষার ব্যবহার নিয়ে। মিডিয়াতে একটি প্রজন্ম এসেছে যারা এখন বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে নাটক, চলচ্চিত্র, স্টেজ শো, উপস্থাপনা সবই করছে। অবশ্যই সাধুবাদ জানাই তাদের সর্বক্ষেত্রে বিচরণের জন্য। তবে যে জায়গাটাতে খানিকটা খটকা লাগলো, তা হচ্ছে সংলাপ বলার ধরন দেখে। প্রথমে শুনে মনে হবে তারা হয়তো ইংরেজী মাধ্যমে পড়ুয়া। তাতেও কোন আপত্তি নেই। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব ছিলো যারা ইংরেজী মাধ্যমে পড়ালেখা করায় বাংলা বলতে তাদের কিছুটা কষ্ট হতো, তবুও যা বলতো একদম ঠিকভাবে বলতো। সেটা বাংলাই হোক কিংবা ইংরেজী। তবে নতুন প্রজন্মের ক্রেজ যারা, তাদের অনেকের কথা শুনেই মনে হতে পারে এরা হয়তো ইংরেজী মাধ্যমে পড়ে এসেছে বলেই বাংলাটা ঠিকমতো বলতে পারছে না। ওদের চিবিয়ে কথা শুনলে নিজেরই অনেক কষ্ট হয় ওদের জন্য।
শুধু তাই নয় সংলাপ আওড়ানোর দুটি ধরনও দেখা যাচ্ছে ইদানিংকালে। এক. কিছু কিছু অভিনেত্রী বিশেষত সংলাপ বাংলায় দিচ্ছেন, কিন্তু মনে হচ্ছে তাদের জিহবার নিচে বরই গোটা বা মার্বেল রেখে কথা বলছেন। কিংবা বাংলা শিখেছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে।
আর দুই. কিছু কিছু অভিনেত্রী বাংলা ও ইংরেজীর মিশেলে কিছু একটা বলছেন, যাকে বাংলিশও বলা যেতে পারে। বাংলা আর ইংরেজী যদি দুটোই বলার থাকে সংলাপ হিসেবে তাহলে প্রত্যেকটি আলাদা করে আর শুদ্ধ করে বলাটা কি ঠিক নয়? you know why আমার আসতে late হয়েছে। এধরনের সংলাপ বলার মানে কী, বোধগম্য না। হয় পুরোটা বাংলা, নয়তো পুরোটা ইংরেজীতে বললে কি শুনতে ভালো লাগতো না? এমনভাবে জগাখিচুরি করে বলা কী নতুন কোনো ঢং কিনা আমার জানা নেই। তবে যারা এধরনের সংলাপ দেদারসে আওড়াচ্ছেন তাদের কাছে অনুরোধ থাকবে বাংলা ভাষাকে এভাবে না চিবানোর। নতুন প্রজন্মের এসব অভিনেত্রীদের অনুসরণ করে তাদের ভক্তরাও একই ঢংয়ে কথা বলা শুরু করেছে।
দেশে জন্ম নিয়ে, সেখানকার ডাল-ভাত খেয়ে যদি আসিফ নামটাকে এজ-ইফ নামে ডাকতে হয় ঢংয়ের চোটে, তখন আসলে মেজাজটা ধরে রাখাটা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বিলেতে নতুন প্রজন্মের বাঙালীরা বেড়ে উঠছে বছরের পর বছর। পারিপার্শ্বিকে অন্য ভাষার প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও তারা কিন্তু ঠিকই বাংলাতে কিংবা আঞ্চলিকে কথা বলার চেষ্টা করছে। তারা যদি পারে, তাহলে দেশে থাকা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সমস্যা কোথায় যে কারণে তারা দেশের মিডিয়াতে বহুদিন কাজ করার পরও বাংলাতে ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না! দেশের মানুষ, সংস্কৃতি কিংবা মিডিয়া কোনকিছুর প্রতিই কি তাদের কোন দায়িত্ব নেই?

সাধনা ছাড়া অতি তাড়াতাড়ি যশ-খ্যাতি পেলে যা হয় তারই প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি নতুন প্রজন্মের ভেতরে। কারো মঞ্চে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই, এমনকি নেই বাংলা শুদ্ধ উচ্চারণের প্রশিক্ষণ। সেই সাথে নেই উচ্চারণ ঠিক করার কোন আগ্রহ। একটা কবিতা ঠিকমতো তারা আবৃত্তি করতে পারবে কিনা তা নিয়েও আমি সন্দিহান। বলিউডে ক্যাটরিনা কাইফ কিংবা জ্যাকুলিন ফার্নান্দেজ ভিনদেশ থেকে এসেও কিন্তু বেশ রপ্ত করেছে হিন্দি ভাষাটা। আর এটি হয়েছে শুধুমাত্র তাদের পেশাগত দায়িত্ববোধের কারণেই। আর আমাদের দেশের অবস্থা উল্টো। সাধনার ধারে-কাছেও কেউ নেই, সৌন্দর্যই যেন মুখ্য। প্রতিভার খুঁটি বেশ নড়বড়ে, তবে ন্যাকামো চূড়ান্ত পর্যায়ে বিদ্যমান। আমার এ লেখা নতুন প্রজন্মের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করবে তা জানা নেই, তবে অনুরোধ থাকবে সংশ্লিষ্ট চ্যানেল কর্তৃপক্ষ এবং টেলিভিশন সংগঠনগুলোর প্রতি যাতে করে নাটক আর বিজ্ঞাপনে বাংলা ভাষাকে নিয়ে কচলানোটা বন্ধ করা হয়।
কিছুদিন আগে টিভি নাটকের বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণে এক প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে কথা বলেছে দেশের টেলিভিশন মিডিয়ার ১২টি সংগঠন। ‘ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশন (এফটিপিও)নামে সংগঠনটি একসাথে সোচ্চার হয়েছিলো ‘সুলতান সুলেমান’ সিরিয়ালের বিপক্ষে। তাদের তাছে অনুরোধ থাকবে, বাংলা ভাষার চর্চাটা নিয়েও খানিকটা সদয় নজর দিতে।
ভাষার মাসে সাদা-কালো রংয়ের পোশাক পরলেই কিন্তু শ্রদ্ধা দেখানো শেষ হয়ে যায় না। অনুভবটা করতে হয় গভীর থেকে। যে ভাষা নিয়ে আমরা সবাই এতো গর্ব করি তা যাতে ম্লান না হয় সেদিকটায় খেয়াল রাখাটা বোধহয় সবারই দায়িত্বের মাঝেই পড়ে।