আমার এখনও কানে বাজে কথাটা। একটা ফোন কল ছিল সেটা। ওই পুরুষটির ছোট বোন। ভাইয়ের সাথে দুই বাচ্চার মায়ের প্রেমকে সে কলুষিত করেছিল ‘বেশ্যা’ আখ্যা দিয়ে। বলেছিল, ‘বেশ্যা’ না হলে এমন নারী প্রেমে পড়ে? আরেক বোন বলেছিল, ‘শুধু বেশ্যাই না, আরও খারাপ আপনি’।
আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল সেই মুহূর্তে, পাল্টা উত্তর দিতে জিভ সরছিল না। অনেকটাই জ্ঞান-বুদ্ধিহীন হয়ে পড়েছিলাম। পুরুষ এবং অনেক নারীও জানে, ছোটবেলা থেকে শেখানো আদর্শগত বুলি-কপচানোর কারণে এই শব্দটির ধার অনেক, মানুষকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয় এই এক শব্দ। তাই এর মোক্ষম ব্যবহারে কেউ সরে না। সুযোগ খোঁজে, সময় মতো দান মারে। সেই থেকে শব্দটি আমার ভিতরে এক বিশাল ক্ষত হয়ে স্পষ্ট হয়ে আছে। আমি একে না পারি মুছতে, না পারি এর থেকে দূরে সরে যেতে। সেই থেকে আজ এতোগুলো বছর পরেও ভিতরে-বাইরে আমাকে আষ্টে-পৃষ্ঠে ঘিরে আছে শব্দটি। আঘাত করে, কষ্ট দেয়।
আমি বলতে পারিনি তখন, হ্যাঁ, আমি বেশ্যা, কিন্তু তোমাদের ভাইয়ের মতোন আদর্শহীন নই; নষ্ট চরিত্রের নই। যে মানুষ সম্পর্কের কমিটমেন্ট রাখতে জানে না, সে কিছুই না আসলে।
আর কীই বা বলবো আমি? নিজেও তো এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলাম এর আগের পাঁচটি বছর ধরে। নিজেকে ‘রক্ষিতা’ মনে হতো। মধ্যবিত্তীয় শিক্ষার স্টেরিওটাইপ ভাঙতে তখনও পারিনি আমি।
একটা সম্পর্কের পরিণতি চেয়েছিলাম আমি, কিন্তু অন্যজন চায়নি, এড়িয়ে গেছে। সম্পর্ক ভাঙতে চেয়েছি, ছলায়-কলায় ধরে রেখেছে, বেরুতে দেয়নি। বলেছে, দেখো, পাথরে ফুল ফোটাতে পারো কীনা! নিজেকে সে কষ্টি পাথরের তৈরি বলেছিল, আমিও প্রতিবার নতুন উদ্যমে ফুল ফোটানোর যত্নে বিভোর হতাম।
সংসারটা ভেঙে যাবার পর সেই মানুষটির প্রেমে আমি পড়েছিলাম, বলা যায়, হাত-পা ভাঙা প্রেম, কালবৈশাখী ঝড়ের মতো উদ্দাম সেই প্রেম, সব হারিয়ে নিজেকে একটু একটু করে আবিষ্কারের সেই প্রেম, সেই প্রেম তো কোনো গোপন কিছু ছিল না। আমিও চাইতাম না তা গোপন থাকুক, আমি চাইতাম আমার ভালোবাসার কথা সবাই জানবে, চিৎকার করে বলতে চাইতাম আমি আমার ভালবাসার কথা, এমনকি আমার ছেলেমেয়েকেও নির্দ্বিধায়ই বলেছিলাম। প্রথমদিকে ওরা জড়তা দেখালেও পরে নিজ উদ্যোগেই সেই লোকটি জড়তা কাটিয়ে ওদের পরম মমতায় কাছে টেনেছিল। অফিসে জানতো, পরিবার জানতো, বাচ্চারা জানতো, কেউ মানতো কীনা জানি না, তবে সামনে পড়লে মেনে নিতো বলেই আজ বোধ হয়। আশপাশের কারও কিছু তেমন করারও ছিল না এই মেনে না নেয়া ছাড়া।
কিন্তু যার সাথে সেই প্রেম, সে কতোটুকু সিরিয়াসলি নিয়েছিল সেই সম্পর্ক, তার উত্তর আজও মেলেনি। বার বার জানতে চাইতাম, আমি কে তোমার জীবনে? কখনও বলতো, আমিই সব, কখনও বলতো, বন্ধুর চেয়েও বেশি। জিজ্ঞ্যেস করতাম, বিয়ে করবে আমাকে? এখানেই চুপ হয়ে যেত পৃথিবী। বলতো, কেন যে তোমার সাথে ১০ বছর আগে দেখা হলো না; বলতাম, দেখা হলে কী হতো? বিয়ে করতে? বলতো, ১০ বছর আগেই সে নাকি ঘোষণা দিয়েছিল, কখনও বিয়ে করবে না। নিজেকে স্বঘোষিত ব্যাচেলর দাবি করতো। কিন্তু এও বলতো, সিদ্ধান্ত বদলাতেও পারে।
এবার আমার প্রশ্ন, তাহলে এই যে আমার সাথে তোমার এই যে সম্পর্ক, এটা কী? একে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবে তুমি? উত্তর নেই, ছিলোও না। এরকম আলোবিহীন সম্পর্ক কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইতাম, পারতাম না। বার বার ফিরে আসতাম আবার নতুন করে অপমানিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে। এমনই যন্ত্রণার জীবন!
আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। আর সে আমাকে ভিতরে ভিতরে তার আর ১০টা মেয়েবন্ধুর মতোই দেখতো, নিয়ম করে ডেট করতো, নিজেকে আকাঙ্খিত ভাবতে এবং বলতে পছন্দ করতো, অনেক মেয়ে তার সঙ্গ চায়। তারপরও আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম। অফিসের কেউ কেউ বলতে বা বলার চেষ্টা করেছিল যে, ওর সাথে মিশবেন না, ওর অনেক মেয়ের সাথে উঠাবসা। আমি কেন জানি কিছুতেই তা বিশ্বাস করতাম না।
এই সম্পর্ক নিয়ে তার নির্লিপ্ততা আমাকে ভাসাতো, ডুবাতো প্রতিনিয়ত। কারণ আমি একা হতে ভয় পেতাম।
যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আজ সম্পর্ক ভাঙার নয় বছর নিয়ে পুরো ১৫টা বছর আমি এই ভাঙা, অপমানিত সম্পর্কের জের টেনে যাচ্ছি। যেমন নিজের জীবনে, তেমনি সন্তানদের জীবনেও। অনেক বড় বড় ভুল সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি এই ভালবাসায় খাবি খেতে খেতে, যখন ভাবি, তখন নিজেকেই ধিক্কার দেই। কিন্তু ওই যে বললাম না, হাত-পা ভাঙা প্রেম!
ডুবতে থাকা মানুষ আমি, সারা জীবন ভালবাসা হাতড়ে বেড়িয়েছি, সেই আমি যখন একটা খড়-কুটোর নাগাল পেলাম, সে কীনা আমাকে স্রেফ ‘মেয়েমানুষ’ ভেবে নিল? তার বোনদের কাছে আমাকে ‘বেশ্যা’ বানিয়ে দিল? ভাবনাগুলোকে, জীবনকে একেবারে বিপর্যস্ত করে দিলো।
প্রচণ্ড মানসিক অসুস্থতা নিয়ে ডা. মোহিত কামালের শরণাপন্ন হই। সব শুনে তিনি আমাকে সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’ বইটা পড়তে বললেন। বইটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টাই, পাতায় পাতায় আমি আমাকেই যেন আবিষ্কার করি।
(চলবে)