আমার শ্যামা সুন্দরীর কথা …

সাবিহা সুলতানা: হাসপাতালে জ্ঞান ফিরে ডক্টরকে যখন জিজ্ঞ্যেস করলাম আমার কী হয়েছে, ছেলে নাকি মেয়ে? ডক্টর উত্তর দিলেন, “আপনার খুব সুন্দর একটা মেয়ে হয়েছে”।
সাথে সাথেই মানসচক্ষে যে ছবিটি ভেসে উঠলো তা হ,লো ফুটফুটে গোলাপী ছোট্ট একটি পরী হাত-পা নেড়ে নেড়ে খেলা করছে। ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। তারপর প্রথম যখন কোলে তুলে নিলাম ওকে, দেখলাম আমার কোলে বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে আমার শ্যামাবর্ণা মেয়ে। কালোর যে কী মায়া এই প্রথম বুঝলাম সেদিন।
দিন যায়, মাস যায়, কন্যা যে আমার কালো থেকে কালোতর হতে থাকে। আত্মীয় স্বজন আসে, কন্যা দেখে প্রথমেই যে কথাটা বলে তা হলো, “ছোটবেলায় এরকমই থাকে সবাই, বড় হলেই ফর্সা হয়ে যাবে।” এর মাঝে খুব কাছের মানুষের কিছু মন্তব্য যেন শেল হয়ে বেঁধে বুকে। আর তাই ও যত কালো হচ্ছিল, ওর জন্য আমার কষ্ট যেন বেড়েই যাচ্ছিল ততো।
আর হবেই না কেন, মুখে যতই আধুনিকতার বুলি ফুটাই না কেন, অন্তরে যে আমি সেই ট্র্যাডিশনাল চিন্তা-ভাবনারই বাহক মাত্র। ছোটবেলা থেকে এই সমাজ আমাকে বুঝিয়েছে যে, যেহেতু আমার গায়ের রঙ ফর্সা, তাই আমি সুন্দরী। আমার চেয়েও হাজার গুণ মায়াবতি চেহারার কালো মেয়েদের অগ্রাহ্য করে আমার মতো বুচি নাকি, এ্যাভারেজ চেহারার মেয়েটাই যে সুন্দরী হিসেবে গণ্য হতো তাতো শুধুমাত্র গায়ের চামড়া ফর্সা হওয়ার কারণেই, তাই আমার মতো গৌড়বর্ণা, সো কল্ড সুন্দরীর কাছে এর দাম তো অনেক হবেই।
আমার সেই ট্র্যাডিশনাল চিন্তা আমাকে আমার মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবায়। মেয়ে যতো বড় হয়, আমার আশেপাশের মানুষের অনেক সুচিন্তিত উপদেশ বাণী আমার কর্ণকুহর ভারী করে। “কী ব্যাপার, মেয়ে তো তোমার মতো হয়নি। ………বেশি করে টাকা জমাও, মেয়ের তো বিয়ে দিতে হবে……মেয়ে তো দিন দিন আরো কালো হয়ে যাচ্ছে … ইত্যাদি ইত্যাদি এবং এই উপদেশ, নির্দেশ, মন্তব্য, উৎকণ্ঠা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমার মেয়ের সামনেই।
সাবিহা সুলতানা

আর তাই আজ যখন মেয়ে আমার আমাকে তার পাশে রেখে আয়নায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “মা, আমি কালো আর তুমি এতো ফর্সা কেন”? আমি বলি, “যারা স্ট্রং, তারাই কালো মা, আমি অনেক দুর্বল তো, তাই আমি ফর্সা” খুব একটা কনভিন্স বলে মনে হয়না ওকে। পাল্টা প্রশ্ন ছোড়ে, “কিন্তু তোমাকে তো দেখতে ভালো লাগে, আমাকে কেন ভালো লাগে না? আমাকে তো সেই কালোই লাগে? স্কুলে জারিনকে সবাই পরীর মতো বলে, আমাকে তো কেউ বলে না। বাইরে গেলে আমাকে সবসময় পার্টি ড্রেস ৱটা পরিয়ে দিবে তো, যেন আমাকে পরীর মতো লাগে।”

ছয় বছরের কন্যার মুখে এমন কথা শুনে স্মম্ভিত হই আমি। শ্যামা বর্ণের প্রতিক্রিয়া তার কোমল মনে অলরেডি পড়তে শুরু করেছে। কাকে দোষ দিবো? এই সমাজকে? দিন দিন এর উপর বর্ণবাদিতার আস্তরণ পড়তে পড়তে তাতো শক্ত কংক্রিট হয়ে গেছে। একদিনে তা তুলবো কী করে?
বলি, “আম্মু সোনা, এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বেবিটি হলো তুমি। তো্মাকে ড্রেস পরে বা সেজে পরী হতে হবে না। তুমি এমনিতেই আমাদের পরী কন্যা, আর আর সেইসাথে তোমার বাবা আর মায়ের নয়নের মনি। তাই তো তুমি কালো। সাদা রঙের কোনো চোখের মণি কি দেখেছ কখনো”? এক নিমিষেই তার কালো চোখে আলো খেলা করে। দৌড়ে এসে গলা জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়ে একছুটে সে চলে যায় খেলতে। আর আমি পরম করুণাময়ের কাছে দোয়া করি, কন্যার এই হাসি, এই খুশি যেন স্থায়ী থাকে আজীবন। আর কখনো কোনদিন যেন কালো বর্ণ নিয়ে তার মনে কোন দ্বিধা তৈরি না হয়। চামড়া তার যতোই কালো হোক না কেন, সেই কালো যেন তার অন্তরকে স্পর্শ না করে কখনো।
জানি এই সমাজ যেমন একদিকে তাকে দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলবে, আবার এই সমাজই তাকে পরোক্ষভাবে মানসিকভাবে স্ট্রং করে তুলবে। ছোটবেলা থেকে এই বৈরিতা সহ্য করতে করতে ও এমনিতেই শিখে যাবে এই তুচ্ছ ব্যাপারগুলিকে অগ্রাহ্য করতে, ঠিক যে কারণে সব কালো মেয়েরা মানসিকভাবে অনেক দৃঢ় হয় ফর্সা নারীদের চাইতে।
ভালো থাকুক আমার শ্যামাসুন্দরী, আর সেই সাথে পৃথিবীর সকল কৃষ্ণকলিরা।
শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.