ধর্ম এবং মানবিকতা

ড. আকতার বানু আলপনা: কিছুদিন আগে ফেসবুকে পড়েছিলাম, নবীজীকে গালি দেওয়ায় এক শিক্ষককে ছাত্ররা মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়েছে। ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটুক্তি, কার্টুন, বিকৃত ছবি, বই ছাপানোর কথা প্রায়ই শোনা যায়। নানা দেশে এসবের তীব্র প্রতিবাদও হয়। কখনো কখনো মাথার দাম নির্ধারণ, ‘মুরতাদ’ ঘোষণা, খুন – এসবও হয়। প্রতিবাদ স্বাভাবিক। কেননা আমাদের ধর্মে তা করতে বলা হয়েছে। শুধু কি ইসলাম ধর্ম নিয়েই লোকে কটুক্তি করে?

না। উদাহরণ দেই।

অনেক পুরনো ভারতীয় বাংলা ছবি ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ ছবিতে ভগবানের বিচার ব্যবস্থাকে তীব্রভাবে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। হিন্দুধর্মে যদি প্রতিবাদ করতে বলা হতো, তাহলে এ ছবি মুক্তি পাবার কথা নয়। ভুলক্রমে মুক্তি পেলেও হিন্দুদের প্রতিবাদের কারণে ব্যান হবার কথা। তা হয়নি। সম্প্রতি ‘পিকে’ ছবিতেও ধর্ম নিয়ে অনেক আপত্তি করার মতো বিষয় উঠে এসেছে। এটিও ব্যান হয়নি।

আকতার বানু আলপনা

বিভিন্ন লেখা, নাটক-সিনেমায় প্রতিনিয়ত ধর্ম নিয়ে মানুষ আপত্তিকর মন্তব্য করে। কিন্তু আমরা মুসলিমরা ছাড়া আর কোনো ধর্মাবলম্বীরা সেভাবে আপত্তি করে না। তাদের ধর্মে তা করতে বলা হয়নি বলেই হয়তো করে না। ভারতের কোনো কোনো রাজ্যে, যেমন গুজরাটে গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। গরুর মাংস খাওয়া ও রাখার গুজব ছড়িয়ে যখন ভারতে মুসলিম হত্যা শুরু হয়, তখন হিন্দু হয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভা দে, ভারতের সুপ্রীম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মার্কন্ডেয় কাটজু প্রকাশ্যে গরুর মাংস খান, খাবেন, এতে দোষের কিছু আছে বলে তারা মনে করেন না, এমন ঘোষণা দেন। কিন্তু আমাদের মতো কোন হিন্দু তাদের ‘মুরতাদ’ জাতীয় কোন ঘোষণা দিয়ে খুন করতে যায়নি।

প্রশ্ন হলো, কেন ইসলামকে নিয়েই বার বার নানা আপত্তিকর মন্তব্য, বই, ছবি প্রকাশ করা হয়? এর কারণ কি? কেন মানুষ ইসলাম বা নবীকে নিয়ে কটুক্তি করে? কী লাভ তাতে?

মানুষের সহজাত কিছু প্রবৃত্তি আছে (যার কারণে অন্যায় জেনেও আমরা কিছু কাজ করি), যেগুলো এর পেছনে দায়ী হতে পারে। যেমন –

– আমাদের প্রবৃত্তি আছে অন্যকে কষ্ট দিয়ে মজা পাওয়া,

– অন্যের মনে আঘাত দিয়ে প্রতিবাদ দেখা,

– আলোচনায় আসা, বিখ্যাত হওয়া, নিজের জ্ঞান জাহির করা,

– নিজে যা পছন্দ করিনা তা অন্য কেউ পছন্দ করুক তা মেনে না নেওয়া,

– নিজের মত অন্যের উপর চাপানো,

– অন্যের স্বাধীনতায় বাধা দেয়া,

– ক্ষমতার অপব্যবহার করা,

– ভিন্ন ধর্মের মানুষের বিশ্বাস বা আচারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাব,

– ভিন্ন ধর্মের লোকেদের হত্যা করে বা উচ্ছেদ করে তাদের সম্পদ বা সম্পত্তি দখল করার জন্য ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় সম্পর্কে কুৎসা রটানো বা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা,

– ধর্ম নিয়ে নানা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য বা বিপরীত মত প্রকাশ করার আরেকটি বড় কারণ হলো ধর্মের নানা বিষয় সম্পর্কে একমত হতে না পারা, বা যুক্তিসঙ্গত মনে না হওয়া।

হতেই পারে। সেটা তার সমস্যা। মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা থাকা দরকার। ভাবতেই পারে যা খুশী। যেমন আমরা ভাবতে পারি আমাদের ধর্ম সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। একজন হিন্দু, বৌদ্ধ বা ক্রিশ্চিয়ান ভাবতে পারে, তার ধর্ম শ্রেষ্ঠ। তেমনি একজন অবিশ্বাসীও ভাবতে পারে, সব ধর্মই মিথ্যা বা বানোয়াট।

অন্য ধর্মের লোকেরা প্রতিবাদ করে না বলেই তাদের ধর্ম নিয়ে কেউ কিছু বলে না বা আমাদের ধর্ম নিয়ে বলে। পশ্চিমা দেশগুলোতে কেউ যদি যীশু বা বাইবেল সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে, তাহলে লোকে দেখে মুচকি হেসে চলে যাবে। কিছুই বলবে না। নিষেধও করবে না। কী বলছে, কেন বলছে জানার চেষ্টাও করবে না।

কাউকে জব্দ করার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হলো, তাকে এড়িয়ে যাওয়া, তার কথায় কান না দেয়া। আমরা কান দেই বলেই সালমান রুশদীরা বিখ্যাত হয়ে যায়, একের পর এক সালমান রুশদী জন্ম নেয়, ইসলাম নিয়ে কটুক্তি বাড়ে, মুসলিমরা কট্টর-উগ্রপন্থী-ধর্মান্ধ হিসেবে কুখ্যাতি কুড়ায়, মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ-নির্যাতন বাড়ে।

একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, একজন বিধর্মী বা অবিশ্বাসী নেতিবাচক কিছু বললেই কি ইসলাম ধংস হয়ে যাবে? ইসলাম কি অতই ঠুনকো? একজন বিধর্মী বা অবিশ্বাসীর কথায় কী এসে যায়?

আমার নানাবাড়ী জয়পুরহাটের দোগাছি ইউনিয়নের ঘাশুরিয়া গ্রামে (পোস্টঅফিস দরগাতলাহাট)। এ গ্রামের ৬/৭ ঘর মুসলিম আর বাকী পুরো গ্রামের বাসিন্দারা হিন্দু। আমার নানা ছিলেন এ গ্রামের প্রধান। সারাজীবন উনি গ্রাম্য নানা সালিশে বিচার করেছেন, গ্রামের মানুষের নানা প্রয়োজনে পাশে থেকেছেন। ছোটবেলা থেকে দেখেছি, যখন পুরো গ্রামে মোটে ২/৩ টা টিউবওয়েল ছিল, তখন নানার বাড়ীর আশপাশের সবকটি হিন্দু বাড়ীর লোকজন নানার কলের পানি খেত, নানার পুকুরে গোসল করতো, ষষ্ঠী পূজার ফল নিয়ে যেত নানার বাগান থেকে।

সবচেয়ে বেশী অবাক হতাম, গ্রামের পূজা-কীর্তনের সময় ঢাকঢোল বাজিয়ে গ্রামের নারী-পুরুষ উৎসব করতো, কিন্তু নানার উঠানে আসতো না। কী সুন্দর সহাবস্থান! গ্রামের প্রতিটা বিয়েতে নানার দাওয়াত থাকতো। নানা তাঁর পুকুরের বড় বড় কাতল মাছ তুলে দিতেন বিয়েতে রান্নার জন্য। নতুন বর-বৌ নিয়ে লোকজন আসতো নানার দোয়া নিতে। নানা নতুন বর-বৌকে দোয়া করতেন, নতুন বৌয়ের হাতে টাকা দিতেন।

নানার সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিলেন যতীন বৈরাগী দাদু। তিনি নানার সাথে বর্ষার দিনে একই ছাতার তলে আধাআধি ভিজতে ভিজতে হাসিমুখে গল্প করতে করতে হাট থেকে ফিরতেন। ছোটবেলায় দাদু আমাকে মাছ ধরার খুতি বানিয়ে দিতেন। আখের জমির ভিতর দিয়ে যে নালা বয়ে গেছে, সেইখানে খুতি ফেলে রাখলে রাতে তাতে মাগুর আর টাকি মাছ পড়তো। কিডনি রোগে ভুগে দাদু মারা যাবার পর গ্রামের হিন্দুদের সাথে আমিও কেঁদেছি।

এখনো নানার বাড়ী গেলে গ্রামের লোকেরা আমাকে দেখে খুব খুশী হোন, একান্ত আপনজনকে দেখলে লোকে যেমন হয়। কুশল বিনিময় করে। আমি অনেকের বাড়ীতে যাই। আমার মনে আছে, আমার সন্তান হবে শুনে এক কাকীমা বলেছিলেন, “আশীর্বাদ করি তোমার ছেলে হোক মা।” আমি অবাক হয়েছিলাম। আমার ছেলে হলেও ওনার কিছু যায় আসে না, মেয়ে হলেও না। ওনার মেয়ের জন্য তিনি যে দোয়া করতেন, আমার জন্যও তাই-ই করেছেন। এরই নাম মানবতা। এখনো নানা কাজে নানার গ্রামের হিন্দু লোকজন রাজশাহী এলে আমাদের বাসায় ওঠে। আম্মা পরম যত্নে তাদের দেখাশোনা করেন। দেখে আমার ভালো লাগে।

গত ২৭ জানুয়ারী শুক্রবার রাত ন’টায় রাজশাহী মেডিকেলে আমার মামা মারা যান। পরের দিন সকালে মামার লাশের পাশে সিঁদুর পরা বৌগুলোকে অঝোরে কাঁদতে দেখে আবার অবাক হলাম। একদিকে শোক, আরেকদিকে ভিন্ন ধর্মের মানুষগুলোর এমন মনের টান আমাকে আনন্দ দিয়েছে এই ভেবে যে, আমাদের মানবিকতাবোধ এখনও পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়নি।

মিয়ানমারে গণহত্যার ছবি ও ভিডিওগুলোতে দেখেছি কী নির্মম নির্যাতন! মানুষের কান্নায় যে মানুষের মন বিচলিত হয় না, সে মানুষ মানুষ নয়। ধার্মিক তো নয়ই। যে স্রষ্টার সৃষ্ট জীবের প্রতি দয়া করতে জানে না, সে স্রষ্টার আদেশকে অমান্য করে। সে ধার্মিক হয় কী করে?

একটা গ্রামের কৃষক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি…. সবার পরিশ্রমের ফল আমাদের কাজে লাগে। ধর্মের বিভাজন করে আমরা তাঁদের অবদান নিতে অস্বীকার করি না। তেমনি পৃথিবীটাকে একটা গ্রাম ধরে নিলে সব ধর্মের মানুষের, এমনকি অবিশ্বাসীদের অবদানকে (জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিকিৎসা, যোগাযোগ… ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে) গ্রহণ না করে আমরা বাঁচতে পারি না।

অথচ শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসের অজুহাতে আমরা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার অপরাধকে আড়াল করি। যারা এটা করে, তারা নিজেরাও জানে সেটা অন্যায়। তবু করে। কারণ ব্যক্তিস্বার্থ মানবতার চেয়ে বড় হয়ে গেছে, দুর্বলের উপর অত্যাচারের শাস্তির নিশ্চয়তা কমেছে, বেড়েছে প্রশ্রয়।

ধর্মের কারণে পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যতো রক্তপাত হয়েছে, আর কোন কারণে কি ততোটা হয়েছে? তাহলে ধর্ম না থাকাই কি ভালো নয়?

একজন হিন্দু পাঁঠার মাংস খেতে পারলে একজন খ্রিস্টান শুকরের মাংস খেতে পারলে একজন মুসলিমেরও গরুর মাংস খাবার অধিকার থাকার কথা। একজনের ধর্ম মানার অধিকার থাকলে আরেকজনের তা না মানার অধিকারও থাকা উচিত। নিজ ধর্মের কেউ ভিন্ন ধর্মের কাউকে মারলে যেমন পাপ হয়, তেমনি নিজ ধর্মের কেউ নিজ ধর্মের কাউকে মারলেও পাপ হবার কথা।

কোনো অজুহাতেই মানুষ হয়ে মানুষকে আঘাত করা উচিত নয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে হলেও নয়। যারা ধর্ম মানে, তারা জানে, অন্যায়ের শাস্তি থেকে স্রষ্টা কাউকে রেহাই দেবেন না। আমরা ধার্মিক হলে স্রষ্টার উপরে আমাদের ভরসা থাকা উচিত।

এখন প্রশ্ন হলো: ভিন্ন ধর্মের কারও দ্বারা নিজ ধর্মের কেউ নির্যাতিত হলে আমরা যতোটা বিচলিত হই, নিজ ধর্মের কেউ ভিন্ন ধর্মের কাউকে নির্যাতন করলে ততোটা বিচলিত হই কি????

বাংলাদেশে হিন্দুরা নির্যাতিত হলে ভারতের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। কোনো ভারতীয় হিন্দু কোনো ভারতীয় মুসলিমকে নির্যাতন করলে তেমন পড়ে কি?

রামুর ঘটনায় মিয়ানমারের লোকেরা যতোটা বিচলিত ছিল, মিয়ানমারে মুসলিম হত্যায় ততোটা ছিল কি?

ভারতে হিন্দুদের দ্বারা, মিয়ানমারে বৌদ্ধদের দ্বারা, ফিলিস্তিনে ইহুদি ইসরায়েলিদের দ্বারা মুসলিমরা নির্যাতিত হলে আমরা যতোটা প্রতিবাদমুখর হই, আমাদের দেশে বৌদ্ধ-হিন্দুরা মুসলিমদের দ্বারা নির্যাতিত হলে ততোটা হই কি? কিংবা পাকিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ায় মুসলমানদের দ্বারা মুসলমানরা নির্যাতিত-খুন হলে ততোটা হই কি????

এই প্রশ্নের জবাব বুকে হাত দিয়ে দিতে পারলেই মানবতার জয় হবে। ধর্ম নিয়ে ধর্মান্ধতা, ধর্মের নামে অধর্ম নির্বাসিত হবে।

লেখক পরিচিতি: 

ড. আকতার বানু আলপনা, সহযোগী অধ্যাপক শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (আই.ই.আর,) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.