সেবিকা দেবনাথ: টুকটাক লেখালেখি করার অভ্যাস আমার সেই ছোট বেলা থেকেই। স্কুল ও কলেজের দেয়াল পত্রিকায় অল্প বিস্তর কিছু লেখা প্রকাশও হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিকতা পেশায় নিজেকে জড়াবো তা কল্পনাতেও ভাবিনি। লেখালেখির সুবাদেই একটা সময় এ পেশায় আসার আগ্রহ জন্মালো। গুটি গুটি পায়ে এ পথে হাঁটতেও শুরু করলাম। তবে চারদিকে আশার আলো যতটা দেখেছি, তার চেয়ে ঢের বেশি দেখেছি হতাশা।
এখনও দেখছি। এক প্যাকেট খাবারের জন্য সাংবাদিকরা হ্যাংলামো করে, অ্যাসাইনমেন্টে গিয়ে খাম চায়, উল্টো-পাল্টা রিপোর্ট করে টাকা দাবি করে। হলুদ সাংবাদিক/ জন্ডিস সাংবাদিক/প্যাকেট সাংবাদিক এমন বহু উপাধি আছে আমাদের। এ পেশায় যারা আছেন তারা সবাই সাধু সে দাবি আমি করছি না। ভালো-মন্দ মিলিয়েই তো সব। তাতে ভালোর সংখ্যাই বেশি বৈ কম হবে না।
অনেকেই বলেন, দেশে নাকি কাকের চেয়ে সাংবাদিকের সংখ্যা বেশি। আর আগাছা/ ব্যাঙের ছাতার মতো নাকি পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইন গজিয়ে উঠেছে। তাই এই দেশে কাকও যা সাংবাদিকও তা। কাক মরলে কি কেউ শোক করে? করে নাতো। তাই সাংবাদিক মরলেও কারও কিছু আসে যায় না।
নিজের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে (মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গিয়েছিলো বলে) সাংবাদিককে তথ্য প্রযুক্তি মামলায় গ্রেফতার করা যায়। তথ্য গোপন করতে সাংবাদিককে হত্যা করা যায়। সাংবাদিককে প্যান্ট চুরির মামলায় ফাঁসানো যায়, তথ্য চাইলে অফিসে ডেকে নিয়ে মারধর করা যায়। রিপোর্ট সংগ্রহ করতে গেলে সাংবাদিকদের মারধর করতে পারে পুলিশ। বোমা মেরে সাংবাদিক হত্যা করা যায়। দুই গ্রুপের মারামারিতে সাংবাদিকের উপর গুলি ছোড়া যায়। আরও অনেক কিছু করা যায়।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত সাংবাদিক আবদুল হাকিম (শিমুল) মারা গেছেন। এ মৃত্যুর খবর শুনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ওই সাংবাদিকের নানী। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান দাবি করছেন, পৌর মেয়র হালিমুল হকের ‘গুলিতেই’ শিমুল মারা গেছেন। পৌর মেয়র ঘটনার পর থেকেই পলাতক। পৌর মেয়রের পক্ষ থেকে নিশ্চই উল্টো অভিযোগ করা হবে।
গুলি যেই করুক সত্য হলো শিমুল ভাই মারা গেছেন। গণমাধ্যমের একজন কর্মী তার পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে নিহত হবেন, হামলার শিকার হবেন, তা মোটেও কোনো সাধারণ-বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির বিবেক। এই বিবেক আজ নিজেই বাকরুদ্ধ। অন্যের অধিকার-মর্যাদার কথা বললেও নিজের বেলায় চুপ থাকতে হয়। সরকার দাবি করছে মুক্ত গণমাধ্যমের বিকাশে সরকার সচেতন। কিন্তু সাংবাদিক নির্যাতন-হত্যাকাণ্ডের ঘটনা যে সাংবাদিকদের অসহায়ত্ব বাড়াচ্ছে।
হত্যাসহ এতো নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার সাংবাদিকদের জন্য আমাদের নেতারা কী করছেন?
বিভিন্ন সময় সাংবাদিক নেতারাও বলেছেন, সাংবাদিকদের মধ্যে বিভক্তির কারণেও সাংবাদিক হত্যা এবং নির্যাতনের ঘটনাগুলোতে উপযুক্ত বিচার পাওয়া যাচ্ছে না। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কোনো ইস্যুতে তাদের ঐক্য হয়েছে বলে আমার জানা নেই। পরে অবশ্য সেই ঐক্যও ভেঙ্গে খান খান হয়েছে। আমাদের মধ্যকার বিভেদ স্পষ্ট করে আমাদের ঐক্যের দুর্বলতা। আর এই সুযোগ কাজ লাগায় সবাই। গণমাধ্যম ও গণমাধ্যম কর্মীদের নিরাপত্তা ও কর্ম-পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তোলার এখনই সময়।
আমি অতি নগণ্য একজন রিপোর্টার। এখনও শিক্ষাণবিশ। তবে এতটুকু বুঝি উন্নয়ন কর্মকা- আর সরকারের মধ্যে দর্পণ হিসেবে কাজ করা সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতনের প্রবণতা বন্ধ না হলে গণতন্ত্রের বিকাশ ও জনগণের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব হবে না। সাংবাদিক নেতাদের কাছে আমার কথা পৌঁছাবে কি না আমি জানি না। তবুও তাদের প্রতি আমার নিবেদন ঐক্যকে বদ্ধ (বন্ধ) করে নয়, আসুন না আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। শিমুল ভাইয়ের হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত এই ঘটনা যেনো অন্য ঘটনার স্রোতে তলিয়ে না যায় সেই দিকটি নিশ্চত করি। পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আর কোন গণমাধ্যম কর্মী যেন নির্যাতনের শিকার না হন। তাকে যেন প্রাণ দিতে না হয়।