পৃথা শারদী:
ঘটনা ১- সাতাশ-আটাশ বছর বয়সী দুজন মানুষের দেশের সেরা সরকারি চাকরির মৌখিক পরীক্ষায় গিয়ে দেখা সাক্ষাত হয়,পরিচয় গড়ায় পরিণয় এ। দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুজন পাশ করেছেন, দুজনেরই মৌখিক পরীক্ষা ভালো হয়েছে, বলা যায়, ছেলেরই বেশি ভালো হয়েছে, মেয়ের চাকরি না হলেও ছেলের চাকরি নিশ্চিত। দু পক্ষের পরিবার দু’য়ে দু’য়ে চার মিলিয়ে চার হাত এক করে দিলেন।
বিয়ে হলো, সংসার শুরু হলো, বহুল আকাঙ্খিত মৌখিক পরীক্ষার ফল বের হলো, সবাই খুশি হলেন আর সাথে সাথে আড়ালে গিয়ে কপাল চাপড়ে নিলেন কারণ চাকরি মেয়েটির হয়েছিল, ছেলেটি সাফল্যের দোরগোড়া থেকে ফিরে এসেছে।
সেই যুগল হাল ছাড়েননি, ছেলেটি বারবার পরীক্ষা দিয়েছেন, একবারও উত্তীর্ণ হতে পারেননি। শেষে এক নন ক্যাডার পোস্টে স্থান হয় ছেলেটির, চাকরিসূত্রে সেই দম্পতির কর্মস্থল হয় একই জায়গায়। অফিসে নানা কাজে, স্বামী তার বউকে কর্মস্থলে ডাকেন,“স্যার, এই ফাইলটা একটু দেখুন! স্যার, আজকে মিটিংটা ওই জায়গায়”।
কী বিপদ! উচ্চপদস্থনারী খুব বিব্রত হন। মনে মনে ভাবেন,” আজকে আমার স্বামী যদি বড় চাকরিখানা করতেন আমি যদি নন-ক্যাডারে চাকরি করতাম, কতই না ভালো হত! জীবনে ছন্দ মিলতো! অফিসে তাঁরা কথা বলেন তৃতীয় পুরুষে! কেউ যদি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, “স্বামী কী করেন?“
ভদ্রমহিলা বলেন, “ব্যবসা“। নানা অনুষ্ঠানে স্বামীকে নিতে চান না। একটাই কারণ, স্বামী তার সমান নন। ঠিক দশ বছর পর শোনা যায়, সেই নারী শেষমেষ পতিদেবকে চাকরি থেকে সরিয়ে এনেছেন, পোস্টিং নিয়েছেন বাইরে। নিজে সুখী, স্বামী সুখী, আশেপাশের সবাই খুশি। অবশেষে সেই দিশেহারা নারী স্বামীকে উপরে না রাখার হীনমন্যতা থেকে বের হতে পেরেছেন।স্বামী বের হতে পেরেছেন অপদস্থ হওয়া থেকে। সবাই এটা মেনে নিয়েছে , স্বামী কিছু করেন না, তবে সবাই এটা মেনে নিতে পারেননি স্বামীর চাকরির পদমর্যাদা স্ত্রী’র নিচে।
ঘটনা ২: যখন তাদের বিয়ে হয়েছিল তখন দুজনই ছিলেন এনজিও’র কর্মকর্তা, হঠাৎ করেই মেয়েটির ইচ্ছে হলো বিসিএস দেবে, স্বামীকে বলার পর স্বামীও রাজী। বিসিএস এ মেয়েটির ভাগ্য সদয়, এখন মেয়েটি ম্যাজিস্ট্রেট। একদিন শখের বশে স্বামীকে অফিস দেখাতে এনে স্যারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে স্যার কিছুই বলেননি এমনভাবে মেয়েটির স্বামীকে বিনামূল্যে উপদেশ ছুঁড়ে দিলেন, “আপনার ওয়াইফের স্ট্যাটাস এখন অনেক বেশি, আপনি পিএইচডি করেন, নাহলে একটা সময় পাত্তা দেবে না বউ আপনাকে“।
উপদেশ শুনে অতঃপর অধোবদনে স্বামী ও স্ত্রী দুজন স্যারের রুম থেকে প্রস্থান করলেন। যদিও জানা গেছে, এই এতো বছরেও দম্পতির মাঝে মানসিক দূরত্ব এতোদিনেও তৈরি হয়নি, বরং বোঝাপড়া বেড়েছে। স্বামী গর্ব করে বলেন ,“আমার সহধর্মিনী এই চাকরি করেন“।
তাদের দেখে মাঝে মাঝে এই সমাজের খটকা লাগে, সমাজ অসুস্থ নাকি এই দম্পতি সুস্থ ! ভদ্রলোকের হীনমন্যতা নেই কেন!

ঘটনা ৩ : মেয়ে অবিবাহিতা, এই দেশের নিয়মে মেঘে মেঘে অনেক বেলা গড়িয়ে গেছে। বিয়ের বাজারে তার সে এখন একটু বয়সী পাত্রী। পাত্রীর দোষ অনেক! পাত্রী নানাকিছু পাশ দেয়া, সর্বগুণে গুণান্বিতা, মাস শেষে কামাই করে মোটা টাকা, বিদ্যাধরীও তিনি কম নন। পিএইচডির জন্য উড়াল দেবেন দেশের বাইরে, এমন মেয়ের জন্য এখন যোগ্য ছেলে খুঁজে পাওয়া ভার!
যোগ্য জামাই! যোগ্য জামাই! যোগ্য জামাই মানে? যোগ্য জামাই মানে যে ছেলের যোগ্যতা মেয়ের থেকে বেশি, পাশে নিয়ে হাঁটতে গেলে যেন ছেলেটার মাথা শুধু শরীরে পাঁচ ইঞ্চি উচু না হয়,যোগ্যতায় যেন হয় পাহাড় সমান বেশি কিংবা যেন হয় সমান সমান, পিএইচডি করতে যাওয়া মেয়ের স্বামী হবে শুধুমাত্র স্নাতক করা, এ চিন্তা মেয়েটি করতে পারলেও পাশে থাকা ছেলেটি চিন্তা করতে চান না। হীনমন্যতায় ভূগতে থাকেন। পরিবারের কেউই এটা চিন্তা করেন না।
ছেলের বাড়ির মানুষেরা সারাজীবন মাথা উঁচু করে চলবেন তাদের বিশাল যোগ্য ছেলে নিয়ে, সেখানে সেই ছেলের যোগ্যতা কম, কীভাবে মানবেন এই ভয়াল সত্য! মেয়ের বাড়ির লোকেরা , সারাজীবন তোয়াজ করবেন জামাই বাবাকে, বিশাল যোগ্য জামাই বাবাকে, যে জামাইকে টেক্কা দিতে হবে পরিবারের আরো দশটা জামাই বাবার সাথে, সেই জামাই যদি মেয়ের চেয়ে কম যোগ্য হয়, সেই জামাইকে নিয়ে কীভাবে মুখ দেখাবেন সবাইকে! ছি ছি ছি!
এই যুগে কি আর তা চলে!
ঘটনা ৪: মেয়েটি নাচেন, মেয়ে নাচ শেখাতে ভালোবাসেন। অনেকদিনের প্রেমের সম্পর্কে অনেক টানাপোড়েন আসে।মেয়েটিরও এসেছিল, প্রেমিকের আগে টাকা রোজগার করতে পারবে না এজন্য নাচের টিউশনি করতে পারেননি। প্রেমের টানে প্রেমিকের অবুঝ(!) জেদে মেয়েটি নাচ শেখাননি, প্রেমিকের চাকরি নিশ্চিত হবার পর মেয়েটি চাকরিতে ঢুকেছেন।
ঘটনা ৫: প্রচণ্ড ভালোবাসার টানে দুজন সংসার করতে শুরু করেছিলেন, ভাগ্যক্রমে ছেলেটি বেকার, মেয়েটি চাকরিজীবী।চাকরি সূত্রে মেয়েটি থাকেন ঢাকার বাইরে, ছেলেটি থাকেন হলে। চাকরি ছাড়া বেকার জীবন, কোনমতে চলে আরকি! তবুও ছেলেটি কামাই করা বউয়ের টাকায় চলেন না। জান দেবো, তবু মান দেবো না ব্যাপার! বউয়ের টাকায় চলা? কাভি নেহি! ভালো তো! ভালো না?
ব্যাটা মানুষ বউয়ের টাকায় চলে না।
এই গেল নানা ঘটনার ঘনঘটা। এসব ঘটনা আমাদের আশেপাশে অহরহ ঘটে যায়, আমরা সবাই মুখ বুঁজে চোখ খুলে সহ্য করে যাই ।
লেখাটি লেখার আগে আমি অধম লেখিকা নানা বয়সী পুরুষকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ঘরের বউ যদি আপনার থেকে যোগ্য বেশি হয় তো কী করবেন? কামাই যদি বেশি করেন? তালিকায় ছিলেন সাধারণ রিকশা চালক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরিজীবী ও স্নাতক পড়া শিক্ষার্থী।
উত্তর পেয়েছিলাম ঝকমারি রকমারি।
বেশ কয়েকজন রিকশাওয়ালা বলেছেন,”বউ বেশি কামাই করলে ভালো হয়, রিকশা চালায় শরীরে কুলায় না”। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ”মামা, তাইলে বউরে কম মারবেন, না?” উত্তরে কেউ হেসেছিলেন, কেউ বলেছিলেন,”কামাই করবো, মারুম ক্যা”?
ডক্টরেট করছেন এমন এক ব্যক্তির উত্তর, ”মেয়েটির জীবন তার কাছে, আমার জীবন আমার কাছে ,সে যদি আমার থেকে ভালো করে আমারই ভালো লাগবে।“ ভদ্রলোক এও স্বীকার করেছেন,”এরকমভাবে ছেলেরা ভাবে কম, কারণ ছেলেরা সুপিরিয়র“।
আমি তাঁর কথা মেনে নিয়েছি, হক কথা।
সরকারি, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করা কয়েকজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করার পর তারা ভ্রু কুঁচকে বলেছিলেন, ”এম্ম, আমার থেকে ভালো! হ্যাঁ, একটু তো লাগবেই খারাপ, মেনে নিব”। জিজ্ঞাসা করেছিলাম,“গর্ববোধ তো হবে? যখন কেউ বলবে তুমি অমুকের স্বামী?“
এক গাল হেসে বলেছিলেন তারা, “হ্যাঁ, তা হবে“। উল্লেখ্য, আমার প্রশ্নোত্তরে বেশিরভাগ ছেলেই এ উত্তর দিয়েছেন।
নবীনদের জিজ্ঞাসা করলাম, তারা বেশ জোর গলায় বললো, ”সমানাধিকারের যুগ। করতেই পারে” তাদের পিঠ চাপড়ে বলেছি, ”বাহ! কথাটা যেন কাজে দেখি“।
প্রবীণ কিছু পুরুষকে জিজ্ঞাসা করার পর স্নেহের সুরে তারা এই নানা প্রশ্নে ভরা লেখিকার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন,“ দেখো,সংসার খুব বড় জায়গা,দাড়িপাল্লাটা নানাভাবে পূরণ করতে হয়,একজনকে নত থাকতে হয়,একজনকে ছাড় দিতে হয়“জিজ্ঞেস করেছিলাম,”কেন শুধু নারীকেই?”
উত্তর পেয়েছিলাম ,”তারা সহনশীল,ছেলেরা এত নয় “
সবশেষে শেষ করি এক বুদ্ধিমান সরকারি কর্মকর্তার বাতচিত দিয়ে, তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “মনে করেন, বউ আপনার থেকে ভালো চাকরি করেন”, ভদ্রলোক আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, “দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমার থেকে ভালো কোন সরকারি চাকরিটা আছে? আমি প্রমাদ গুণে পাশ কাটিয়ে বললাম, “আরে, ধরেন আছে। আপনি বউ এর পরিচয়ে পরিচিত হবেন, এটা মানতে পারবেন?”
ভদ্রলোক হেসে জবাব দিলেন, ”আমার এই চাকরি-বাকরি ভাল্লাগে না, বউ যদি আমার থেকে ভালো চাকরি করে তো আমি চাকরি ছেড়ে দিব“, আমি মনে মনে ভাবি, এই লোক তো মহা ভ্যাজালের! উলটা-পালটা কথা বলে! একটু পরে সেই সরস ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ”তার আগে আমাকে বলেন তো, কোন মেয়েটা তার থেকে কম স্ট্যাটাসের, কম যোগ্য ছেলে বিয়ে করবে? একটা পর্যায়ে যাবার পর মেয়েরাই চান না তাদের থেকে কম যোগ্য ছেলেদের বিয়ে করতে, তবে এটা মানসিকতার ওপর নির্ভর করে।
ভদ্রলোকের হাহাকার ভরা উত্তর ও ঝামা ঘষা প্রশ্ন শুনে আমি হাজার প্রশ্নে প্যাঁচ খাওয়া মেয়ে ভাবি, আহা! তাই তো! মেয়েরাই তো চায় সুপিরিয়র বর ,মেয়েরাই চায় বিয়ের পর হালকা গর্ব মিশিয়ে বলতে, “আমার স্বামী ……..করে, অন্য মেয়েদের ঈর্ষাকাতর চোখ দেখতে কোন মেয়ের না ভালো লাগে!“
চিরন্তন নিয়মানুসারে ছেলেরাই হবেন হর্তা কর্তা, ছেলেরাই হবেন পরিবারের সেরা চাকুরে, ছেলেরাই হবেন সম্পর্কের সিদ্ধান্ত নেয়ার মানুষ। এই ছেলেরাই হীনমন্যতায় ভোগেন যদি তার পাশের সঙ্গিটি তার থেকে বিদ্যা বুদ্ধি ও কর্মস্থলে এগিয়ে থাকেন, যদি সঙ্গিনীর পরিবার ছেলেটির থেকে ভালো হয়। অদ্ভুত ব্যাপার এটাই! ছেলেটিকে যদি সারাক্ষণ তার সঙ্গিনী মানসিকভাবে বোঝাতেও থাকেন হীনমন্যতার কিছু হয়নি, তারপরেও ছেলের কাঁধে এই হীনমন্যতা সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে থাকে, বারবার তার মাথায় আসে, আমি কেন সুপিরিয়র হলাম না! কেন হলাম না! কেন জীবনে এতো ট্র্যাজেডি হলো! কেন! কেন! কেন!
বাইরের দেশে অনেক সময় মেয়েরা সংসার চালায়, বাইরের দেশে একটা ছেলে ঘরের সব কাজ দেখ, মেয়েটার টাকায় ঘর চলে, গাড়ি কেনা হয়। কই, তারা তো সুখহীন জীবনে বাঁচে না! এদেশে এখনো একটা ছেলেই কামাই করবে, একটা ছেলেই সংসার খরচ দেবে, একটা ছেলের নামের অংশ এখনো মেয়েটার নামের শেষে লাগানো হবে।
কেন? কী হয় তাদের পয়সায় সংসারটা চালালে, কী হয় কর্মক্ষেত্রে সামনে থাকলে, পিএইচডি ডিগ্রীধারী হলে?
এতো হীনমন্যতা কেন?
বেচারা ছেলে জাতের দোষটা আর কই! ওদিক থেকে ঠেলা খেলে, এদিকে তো মনে মনে হীনমন্যতাই বেড়ে চলবে!
একটা কথা ঘুরেফিরে চলে আসে, মানসিক বোঝাপড়ার চাইতে বড় আর কিছুই হয় না, এমন অনেক নজির আছে দুনিয়াতে একই ছাদের নিচে কর্মক্ষেত্রে সফল দুজন মানুষ রাতের বেলা হীনমন্যতায় ভোগেন। নাহ! চাকরির জন্য নয়, সুখের জন্য অসুখী হয়ে বেঁচে আছেন। সুখের কথা তবুও এটাই যে, এই সমাজেও কিছু মানুষ এই হীনমন্যতাকে দূর করে ভালো আছেন, তাদের জীবনে হীনমন্যতা নেই, সুখ আছে। আমাদের এই সমাজে এই পরিবর্তনটাই কম কী!
দুজন ছেলেমেয়ের মাঝে কে, কী করবে না করবে, এটা যদি ছেলেমেয়ে হিসেবে চিন্তা না করে শুধুমাত্র মানুষ হিসেবে চিন্তা করা হয়, এতো কথার উদয় তাহলে হয় না। হীনমন্যতাগুলো নিমিষে উধাও হয়।
তাই চলুন, আমরা একটু আমাদের মানুষ ভাবি!
প্লিজ ।।