শাশ্বতী বিপ্লব: আমরা মায়েরা যারা কাজ করি, তাদেরকে প্রতিনিয়ত কত রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয় তা কেবল আমরাই জানি।শুধুমাত্র নিজের ছোট্ট সন্তানটাকে যদি একটু সাথে নিয়ে আসা যায়, তাকে একটু হেসেখেলে বেড়ানোর, একটু ঘুমানোর আয়োজন যদি সেই সংস্থার কতৃপক্ষ করে দেন, তবে সেটা সেই কর্মজীবী মায়ের জন্য যে কত বড় একটা সাপোর্ট হয়, সেটা বলে বোঝানো কঠিন। শুধুমাত্র এই সুবিধাটার অভাবে অনেক মাকেই শেষ পর্যন্ত চাকরীটা ছেড়ে দিতে হয়। আজ নিজের সেরকমই একটা অভিজ্ঞতা বলবো আপনাদের।
সময়টা ২০০৭। একটি নামকরা আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরী পেয়েছি। যারা শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে। মনে খুব আনন্দ। কত কিছু জানার আছে, শেখার আছে। কিন্তু চাকরীতে ঢুকেই যে ধাক্কাটা প্রথম খেলাম সেটা হলো সবার মনে একধরনের চাপা ভয় আর অসন্তোষ। কেউ সেগুলো নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করার সাহস পায় না। কারণ কীভাবে যেন সেটা ঠিক ঠিক ম্যানেজমেন্টের কাছে পৌঁছে যায়।
নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা নয় বরং একটি নির্দিষ্ট জেলাকে প্রাধান্য দেয়া (যারা কাজ কম, গুপ্তচরগিরি বেশি করে), মেয়ে কর্মীদের নানাভাবে অবমূল্যায়ন ও হেনস্থা করা (যার থেকে এসিস্ট্যান্ট কান্ট্রি ডিরেক্টরও রেহাই পেতেন না শুধুমাত্র নারী বলে), পোশাক নিয়ে কটাক্ষ করা থেকে শুরু করে এক নারী সহকর্মীর সন্তান হয় না বলে তাকে আড়ালে “বাজা মহিলা” বলে ডাকার মতো একটা অসুস্থ পরিবেশ বিরাজ করতো সেখানে।
একটি সদ্য বিবাহিত মেয়েকে নিয়োগপত্র হাতে দেয়ার সময় এইচআর হেড তার আপাদমস্তকে বাজেভাবে চোখ বুলিয়ে জানতে চাইলেন, “আপনি নিউলী ম্যারেড দেখছি, আবার প্রেগনেন্ট নাতো? একবছর না হলে কিন্তু ছুটি পাবেন না।“ মেয়েটি কোন রকমে উত্তর দিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচলো।
আরেকটি মেয়ে, একটু সিনিয়ার পজিশনে জয়েন করেছেন। সেসময় তিনি সন্তানসম্ভবা ছিলেন মাত্র কয়েক মাসের। উনাকে দেখে বোঝা যায়নি। প্রসঙ্গ আসেনি বলে উনিও ইন্টারভিউয়ের সময় সেটা বলেননি। পরে যখন টের পাওয়া গেলো তখন কান্ট্রি ডিরেক্টর আর এইচআর মিলে তার জীবন অতিষ্ট করে তুললো। উনি শেষ পর্যন্ত চাকরীটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন।
শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করলেও সেখানে কর্মরত নারীদের শিশুদের জন্য কোন সুব্যবস্থা ছিলো না। মেয়েরা নিজের শিশু সন্তান নিয়ে কোন সমস্যা বলতে বা সহযোগিতা চাইতে ভয় পেতো। চারতলা অফিসের দোতলায় একটি স্যাঁতস্যাঁতে কক্ষে (যেটা মূলতঃ গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হতো) একজন নারী সহকর্মী তার দেড় দুই বছরের বাচ্চাকে এনে রাখতেন। আলো বাতাস নেই, অন্ধকার গুমোট একটা ঘর। সাথে আরেকটি ১৩/১৪ বছরের মেয়ে থাকতো দেখাশোনা করার জন্য। তার এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। এতোটুকু যে পাচ্ছেন তাতেই কৃতজ্ঞ ছিলেন। যাদের ন্যুনতম বিকল্প ছিলো তারা না আনাটাকেই উত্তম মনে করতেন।
আমার বড় ছেলেটাও তখন একই বয়সী। আমি প্রায়ই ওই বাচ্চাটাকে দেখতে যেতাম এবং আমার মন খারাপ হতো। এই অন্যায়গুলো মানতে কষ্ট হতো। কী করা যায় ভাবতাম। প্রতিবাদ করা শুরু করলাম। ব্যাস, আমার উপরে ওপর মহলের গজব নেমে এলো। প্রতি পদক্ষেপে নানারকম হেনস্তা করার চেষ্টা, বরখাস্ত করার হুমকী। পরীক্ষা দিয়ে প্রথম হওয়ার পরও সিনিয়র পজিশনে না নেয়ার মতো অন্যায়ের শিকার হলাম।আর গুপ্তচরেরা তো ছিলই বসদের সুনজরে থাকার জন্য সারাক্ষণ সত্যমিথ্যা মিলিয়ে কান ভারী করার জন্য।
কিন্তু আমি হাল ছাড়লাম না। অন্য সবকিছু বাদ দিলেও সেখানে কাজ করা মা-বাবাদের ছোট শিশুদের জন্য একটা ভালো কক্ষ আর কিছু সুযোগ সুবিধা দেয়ার জন্য গোঁ ধরে রইলাম। ম্যানেজমেন্টের বিরক্তি উপেক্ষা করে যেকোন ফোরামে সুযোগ পেলেই দাবী জানাতে থাকলাম, একাই। কেউ প্রকাশ্যে সমর্থন জানালো না। কেন সেটা আমার কাছে আজো একটা রহস্য।নারী সহকর্মীরা আমাকে বললো, “আপা, এইটা কোনদিন হবে না, বাদ দেন। আমরা অন্যদের শিশু অধিকার শেখাই ঠিকই,কিন্তু আমাদের সন্তানদের জন্য শিশু অধিকার না। মনে রাখবেন।“
আমি মনে রাখলাম না, বাদও দিলাম না। মরার উপর খাড়ার ঘাঁ-এর মতো আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একবছরের এক সিনিয়র আপা জয়েন করলো। যে কিনা বামদল করতো। আমরা একই হলে থাকতাম। কোন এক অজানা কারণে চাকরীতে ঢুকেই সে আমার বিরুদ্ধে দল পাকানো শুরু করলো। সবাইকে বলে বেড়াতে লাগলো, “এইগুলা সব ওর স্টানবাজী। আমি ওকে খুব ভালোমতো চিনি।“ কথাটা আমার কানেও এলো। অবাক হলেও পাত্তা দিলাম না, কিছু জিজ্ঞেসও করলাম না। আমি আমার কাজ করতে লাগলাম।
দীর্ঘ প্রায় আড়াই বছর লেগে থাকার পর শেষ পর্যন্ত আশার আলোর দেখা পেলাম। আমাকে বলা হলো একটা কনসেপ্ট নোট এবং বাজেট করতে। আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে কয়েকটা সংস্থার “ডে কেয়ার” ঘুরে দেখলাম, কনসেপ্ট নোট লিখলাম, বাজেট বানালাম। একটি টিম করে দেয়া হলো। যে দেশের এই সংস্থাটি, সেখান থেকে প্রতিনিধি এলো। আমি তাদের প্রশ্নের উত্তর দিলাম। এবং শেষ পর্যন্ত খুব ভালো না হলেও মেটামুটি সুযোগ-সুবিধাসহ একটি কক্ষ বরাদ্দ দেয়া হলো আমাদের শিশুদের জন্য। নিয়ম-কানুন ঠিক করা হলো। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল কর্মী তাদের সন্তানদের রাখতে পারবেন সেখানে।
যে মেয়েটিকে নিয়োগের সময় প্রশ্ন করা হয়েছিলো সে প্রেগনেন্ট কিনা, সে ততদিনে মা হয়েছে। সে মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে চারমাসের মেয়েকে নিয়ে অফিস করা শুরু করলো। ওর মেয়েটা ওই রুমে থাকতো, আর ও নির্দিষ্ট সময় পরপর গিয়ে দুধ খাইয়ে আসতে পারতো। কিযে শান্তি লাগতো আমার দেখে বলে বোঝাতে পারবো না। আমিও সময় পেলে দেখতে যেতাম কেমন চলছে, কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা।
ততদিনে আমিও সন্তানসম্ভবা। সবকিছু ঠিকঠাক করে ছুটিতে চলে গেলাম। ফিরে এসে অবশ্য আমাকে এই সুবিধাটুকু নিতে হয়নি। আমি নতুন একটা চাকরি নিয়ে আরেকটা সংস্থায় চলে গেলাম। রেখে এলাম আমাদের সন্তানদের জন্য একবিন্দু চেষ্টা। একটি “ডে কেয়ার” বা “ক্রেশ”, যে নামেই ডাকা হোক।
সবশেষে বলি, হাল ছাড়তে নেই, সাহসও হারাতে নেই। যারা পেছনে কথা বলার, পথে কাঁটা বিছানোর, তাদের সেটা করতে দিন। আপনি নিজের কাজটা দৃঢ় সংকল্পে করে যান। জয় আপনারই হবে।