আনা নাসরীন: রাকিবকে মনে আছে আমাদের? রাজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলার কিছুদিন পর শরীরে কম্প্রেসড বাতাস ঢুকিয়ে মেরে ফেলা হয় যাকে? পরপর এমন মর্মান্তিক দু’টো ঘটনা কী ভয়ঙ্করভাবেই না কাঁপিয়ে দিয়েছিলো আমাদের! সেই সময়ের ফেসবুক আমাদের কষ্টের আর্তনাদের সাক্ষী হয়ে আছে এখনও।
এরপর কী হলো বোঝার জন্য একটা প্রাসঙ্গিক তথ্য – রাকিবকে যে পদ্ধতিতে মেরে ফেলা হয়, সেই পদ্ধতিতে মেরে ফেলার চেষ্টা হয় অন্তত আরও পাঁচজনকে, যাদের মধ্যে মারা যায় তিনজন। সর্বশেষ ঘটনাটি কিছুদিন আগের।
(দেখুন-http://m.prothom-alo.com/bangladesh/article/1040113/নারায়ণগঞ্জে-‘পায়ুপথে-বাতাস-ঢুকিয়ে-কিশোর-হত্যা’)।
১৫ ডিসেম্বর, যেদিন শরীরে কম্প্রেসড বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করার সর্বশেষ ঘটনাটি নারায়ণগঞ্জে ঘটে, সেদিনকার ফেসবুক আমি নিজেই ঘেঁটে দেখেছি। আমার অনুমান সত্যি বলে প্রমাণিত হলো – এই শিশুটির এমন মৃত্যুতে আমাদের কোন আহাজারি তো নেই-ই, এমনকি কেউ এই খবরটা জাস্ট শেয়ারও করেনি। কেন হলো এটা? একটা মর্মান্তিক ঘটনার প্রেক্ষিতে তীব্রভাবে ফেটে পড়ে আমাদের সব শক্তি শেষ? কিংবা আমাদের সব কর্তব্য পালন হয়ে গেছে?
মনে পড়ে যায় বাঙালির চরিত্র নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল্যায়নের প্রথম বাক্যটি ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না’। কিছুদিন আগে পূজার ঘটনায় আবার আমরা কেঁপে উঠেছিলাম – শিশুটিকে ধর্ষণ করতে গিয়ে যে বীভৎস অত্যাচার করা হয়েছিলো, সেটা আমাদেরকে ক্ষতবিক্ষত করেছিলো। আমরা অনুভব করেছিলাম ওই শিশুর গায়ের প্রতিটা ক্ষত, ব্লেডের আঁচড় আমাদেরই গায়ে পড়েছিলো। এই সহানুভূতি, সহমর্মিতা ছিলো অভাবনীয়।
মাঝে মাঝেই শোনা যায় আমাদের দেশের মানুষ অন্যের দুঃখ-কষ্টের প্রতি উদাসীন হয়ে গেছে; রাজন-রাকিবের মতো পূজা’র ঘটনার পর আমাদের প্রতিক্রিয়াকে কেউ কেউ ওই পরিস্থিতিতির একটা পাল্টা যুক্তি হিসাবে দেখাতে চাইবেন। কিন্তু আমি সেটা মনে করি না।
পরবর্তী আলোচনার আগে পত্রিকায় প্রকাশিত আরেকটা খবর একটু পড়ে নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় তোফা মনি নামের সাত বছরের একটি বাচ্চা ধর্ষিত হয়েছে। কিন্তু তোফা পূজার মতো সৌভাগ্যবান ছিল না – বীভৎস অত্যাচারের পরও পূজা বেঁচে গিয়েছিলো, কিন্তু তোফা খুন হয়েছে (http://m.prothom-alo.com/bangladesh/article/1044461)।
খবরটা মাসখানেক আগের, কিন্তু এরকম খবর হরহামেশাই আমাদের পত্রিকায় আসে। বলা বাহুল্য আমরা তখন এসব খবরে কোন উচ্চবাচ্চ্য করি না, যেমনটা করেছি পূজার ক্ষেত্রে।
ধর্ষণের মতো বর্বরতম অপরাধটি যখন হয় নিতান্ত শিশুর ওপর, তখন সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর যদি এর জেরে শিশুটি মারা যায়, তাহলে? কিন্তু আমাদের সমাজে এমন ঘটনা ঘটে চলে প্রতিনিয়তই। এর জন্য দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতাকে দায়ী করতেই পারি আমরা, সেটা যৌক্তিকও। কিন্তু আমাদের নিজেদের দায় কি আমরা দেখার চেষ্টা করি একটুও?
একটা রাষ্ট্র মানুষ গঠন করার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা হলো নিরাপত্তা পাওয়া। সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, এবং কোন অপরাধ ঘটলে সেটার শাস্তি নিশ্চিত করে সেই ধরনের অপরাধ রোধ করার দায়িত্ব নিশ্চয়ই রাষ্ট্রের। কিন্তু বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে এটা হয় না; কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামান্য যতটা হয়, সেটা হয় নাগরিকদের সম্মিলিত চাপের ফলে। আমরা কি করি সেটা?
কোনো একটা ঘটনা যদি যথেষ্ট পরিমাণে প্রচার পায়, তখন আমরা সবাই সেটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি, কিন্তু এরপর একই ধরনের ঘটনা, কিংবা এর চাইতেও ভয়ঙ্কর ঘটনা আমাদের সামনে এলেও আমরা আগের মতো প্রতিক্রিয়া জানানো দূরে থাকুক, প্রায় নির্বিকার থাকি। তাই কোন একটা নির্দিষ্ট ইস্যুতে চাপ জারি থাকে না।
পূজা আর তোফার ঘটনায় আমরা সেটাই দেখলাম। অথচ কোন একটা নির্দিষ্ট ইস্যুতে আমরা যদি ক্রমাগত চাপ জারি রেখে যেতে পারতাম, তাহলে সেই সম্মিলিত চাপের মুখে ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণে সরকার অনেকটাই বাধ্য হতো।
তোফাকে ধর্ষণ করে হত্যা করার খবরের লিঙ্কটি এই লিখার সাথে সংযুক্ত করা আছে। সেটি শেয়ার করে আমরা কি এই বর্বর অপরাধের বিরুদ্ধে ফেটে পড়বো? ভবিষ্যতে আবার এমন কোন ঘটনা ছোট শিরোনাম হলেও সেটা খুঁজে নিয়ে কি আমরা প্রতিবাদ চালিয়ে যাবো?
সম্ভবত না। তাই এই দেশে শিশু ধর্ষণ, আর সেটা থেকে অনেকের মৃত্যু আমাদের দেখে যেতে হবে বহুকাল। আমরা আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে নিজেদের প্রবোধ দেবো – পূজার ঘটনায় আমরা প্রতিবাদ করেছি না? আমাদের কর্তব্য তো শেষ।