মাসকাওয়াথ আহসান: পাকিস্তানের সোয়াত নয়; বাংলাদেশের গাইবান্ধার কুন্দের পাড়ায় গণ উন্নয়ন একাডেমী হাইস্কুল নামের একটি বালিকা বিদ্যালয় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ‘দুর্বৃত্ত’ শব্দটি আমাদের খুব চেনা একটি শব্দ, যা অজুহাতের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার গভীর রাতে গান পাউডার বা পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলা হয় ছাত্রীদের স্বপ্নের ঠিকানা। চরাঞ্চলের যে ছাত্রীরা যাতায়াতের অসুবিধার কারণে পঞ্চম শ্রেণী শেষ করেই শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে যেতো, তাদের অন্ততঃ এসএসসি পাশ করানোর ব্যাপারে কোন সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়েনি। সরকার ব্যস্ত থাকে শাসন আর ভাষণ নিয়ে। ফলে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে গড়ে ওঠে এই স্কুলটি। ঐ এলাকার মানুষের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে যায় এই বিদ্যায়তন। কারণ এখানেই প্রান্তিক উপায়হীন মানুষের সন্তানেরা শিক্ষার আলোয় দীপিত হয়। অভিভাবকেরা জানেন তাদের দাস জীবনের সমাপ্তি টানতে পরবর্তী প্রজন্মকে উড়িয়ে দিতে হবে বর্ণমালার আলোর ডানায়।
সকালে এসে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া প্রিয় বিদ্যালয়টি দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ছাত্রীরা। এই একই ট্র্যাজেডি ঘটেছিলো পাকিস্তানের সোয়াতে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই ও তার সহপাঠীদের জীবনে। তারাও একদিন ভোরবেলা এসে দেখেছিলো তাদের প্রিয় বিদ্যালয় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পাকিস্তানে ঘটনাটি ঘটিয়েছিলো উগ্রবাদী মুসলিম সন্ত্রাসীরা। বাংলাদেশের গাইবান্ধার ঘটনাটি অবশ্য আপাততঃ দুর্বৃত্তরা ঘটিয়েছে।
“খতিয়ে দেখা” হচ্ছে আসলে কারা পুড়িয়েছে। খতিয়ে দেখা আরেকটি ভয়ংকর শব্দবন্ধ, যা অজুহাতের প্রতিশব্দ। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও ঐ এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান স্কুলটিকে ভালোবাসেন। পোড়া স্কুল দেখে ছাত্রীদের অসহায় কান্না দেখে তারাও কেঁদেছেন। কারণ এই স্কুলটি না থাকলে ঐ এলাকার শিক্ষার যে সম্ভাবনা গড়ে উঠেছিলো; তা অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়বে। এই বিদ্যায়তনটি তাদের ক্ষুদ্র সামর্থ্যে শিক্ষার্থীদের জন্য হোস্টেলের ব্যবস্থা করেছিলো; যাতে দূর-দুরান্তের শিক্ষার্থীরা শিক্ষার অধিকার বঞ্চিত না হয়।
যে দুর্বৃত্তরা বালিকা বিদ্যালয় পুড়িয়েছে তারা সুস্থ মস্তিষ্কের নয় এটা সহজেই অনুমেয়। কারণ সামনে এস এস সি পরীক্ষা; ছাত্রীদের যাতে এই পরীক্ষাটা দেয়া না হয় সেরকম একটি অশুভ ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়েছে তাদের অপকর্মে। এই স্কুলের আগে দেশের অন্যত্র আরেকটি স্কুল আক্রান্ত হবার খবর আমাদের কানে এসেছিলো, তারপর সেটি হারিয়ে যায় অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় ব্রেকিং নিউজের তোড়ে, যেমন আলাউদ্দীন খাঁ জাদুঘর ও সংগীত বিদ্যালয় ভেঙ্গে ফেলার কারণ খতিয়ে দেখার কাজ শেষ আজো হয়নি।
কুন্দের পাড়ার স্কুল পোড়ানোকে ঘিরে অন্যান্য সন্দেহের মাঝে এলাকায় আরেকটি স্কুল করতে চাওয়া প্রতিপক্ষের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একটু খুঁজে দেখা প্রয়োজন তারা ঠিক কী রকমের স্কুল বানাতে চাচ্ছিলো! এই প্রতিপক্ষকে বাদ দিলে দেশের অন্যান্য জায়গায় স্কুলে হামলা বা সংগীত বিদ্যালয় যারা ভেঙ্গেছে, তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মিলে যায় এই ঘটনাটি।

স্থানীয় নারী সাংসদ অবশ্য পুড়ে যাওয়া স্কুল পরিদর্শন করেছেন। এটি একটি স্বস্তির ব্যাপার যে তিনি একজন নারী; তিনি জানেন আমাদের সমাজ নারীর সম্ভাবনাগুলোকে প্রতিদিন হত্যা করে। মেট্রোপলিটান, ছোট-বড় শহরগুলোতেই নিয়মিত নারীর প্রতি অবিচার ও বৈষম্যের ঘটনা ঘটছে। সেখানে প্রত্যন্তের চরাঞ্চলের কন্যা-শিশুদের স্কুল পুড়িয়ে দেবার পেছনে কীরকম বর্বর প্রতিহিংসা কাজ করেছে; তা সহজেই অনুমেয়।
গাইবান্ধায় কুন্দের পাড়ায় গণ উন্নয়ন একাডেমী হাইস্কুল নামের একটি বালিকা বিদ্যালয়ে এই ট্র্যাজেডি ঘটে যাওয়ার পরেও তাদের স্বপ্ন থেমে থাকেনি। বন্যার সময় ব্যবহৃত তাঁবু খাটিয়ে আর খোলা আকাশের নিচে স্কুলের ক্লাস চলছে। বিভ্রান্ত সময়ের উদ্দেশ্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা, উদভ্রান্ত সমাজ কাঠামোতে সচেতন জনারণ্যেও এমন স্বপ্ন জাগানিয়া ঋজু প্রতিবাদের দৃষ্টান্ত চোখে পড়েনি।
আমরা বুঝে গেছি গাইবান্ধার অন্ধকারে আলোর মশাল জ্বেলে রাখার মতো আত্মবিশ্বাস আর স্বপ্নের শক্তি রয়েছে প্রান্তিক অবহেলিত শিক্ষার্থীদের। চরাঞ্চলের স্বশিক্ষিত মানুষগুলো আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো মুক্তির লড়াই কীভাবে লড়তে হয়।