মুমিতুল মিম্মা: জীবনে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার শুরুটা হয়েছিল ছাত্র পড়িয়ে। গত তিন বছরের বিচিত্র ঘটনার সমাহার হলো সেখানে গিয়ে। তার দুটো ঘটনা লিখছি-
#ঘটনা-১
এক ছাত্রের বাসায় গিয়েছি। ছেলে সেইন্ট যোসেফ কলেজে পড়তো তখন। তো আমাকে দেখে ওর বাবা পুরোই বিরক্ত। আমাকে যিনি নিয়ে গিয়েছিলেন আমারই সামনে তাঁকে বললেন “আমি মেয়ে দিয়ে কখনওই পড়াই নি”। আমি বললাম, “ছেলে মেয়ে ভেদাভেদ আসবে কেন? আমি পড়তে পারি কিনা এটা দেখার বিষয়” তিনি কিছু বললেন না এর উত্তরে। আমাকে কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাকে কত দিতে হবে?” আমি বললাম, “যেহেতু একাদশ আমাকে দশ দেয়া লাগবে” তিনি আঁতকে উঠে বললেন, “তুমি মেয়ে। তুমি এতো টাকা দিয়ে কী করবে? ছেলেদের না হয় হাত খরচ থাকে মেয়েদের তো থাকে না।” আমি পুরাই আক্কেল গুড়ুম! মেয়ে বলে আমাকে কম দেয়া জায়েজ আছে তাহলে যেহেতু হাত খরচ নেই! পরে অবশ্য নয় হাজারেই পড়িয়েছিলাম দু মাস তাঁকে।
#ঘটনা-২
তখন রোজা চলছে। রোজার ভেতরে এক দশম শ্রেণির মেয়ের বাবা আমাকে ফোন করলেন তার বাসায় একটু গিয়ে কথা বলতে হবে। নিজে মেয়ে বলে আমার একটা সুরক্ষা দরকার এই ভয় কোনদিন ছিল না। যেতে বলেছেন সুন্দর করে তার বাসায় গেলাম। গিয়ে কথাচক্রে জানতে পারলাম ভদ্রলোক বিপত্নীক। আমি খুবই দুঃখিত হলাম জিজ্ঞেস করলাম, “আন্টি কী হঠাৎ করে মারা গেছেন?” তিনি বললেন, “না, আমার এই মেয়েটা জন্মের পর থেকেই তিনি শয্যাশয়ী। আর মারা গেছে ভালো হয়েছে। অসুস্থ রোগী টানা একটা ঝামেলা। চিকিৎসার খরচ এই খরচ সেই খরচ!” আমি ধাক্কা খেলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বাচ্চাটা তো তাহলে খুব একা হয়ে গেছে” তিনি বললেন, “না একা থাকবে কেন? আমি আছি আমার বুয়া আছে!”
শুনে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল! নিজে প্রচণ্ড অপমানিতবোধ করেছিলাম সেদিন। কী নির্লজ্জভাবে একজন ‘পুরুষ’ তার বুয়া বৃত্তান্ত আরেকজন অপরিচিত মেয়ের সামনে বলতে পারেন! আমার মুখ তেতো হয়ে গিয়েছিল। “পুরুষ মানুষের লজ্জার কী আছে” – যারা বলেন তারা নিজেরা কতটা স্থুল মানসিকতার এই ভেবেই আমার গা ঘিনঘিন করে এখন।
মেয়ে বলে একটা শারীরিক অঙ্গ নিয়ে আলাদা করে ভাবতে ইচ্ছে হয়নি কখনও। ভাবিনি তাই। কিন্তু ইদানিং পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসন যেই স্থুল পর্যায়ে পড়েছে তাতে শুধু বলে-লিখে কাজ হবে বলে মনে হয় না। নারীর প্রথাবিরোধী কাজে আমাদের আঁতে ঘা লাগে।
নারীর হাতে তামাক প্রাচীনকাল থেকেই আছে। বিড়ি থেকে সিগারেট উঠতেই- পুরুষবাদীদের লেগে গেল? একজন নারী সারাদিন কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে যাবার জন্যে সিগারেট খেলে আমাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গেল; আমরা ‘বামাতি’ বলে গাল দিয়ে, ‘টিয়ারশেলের আগুনে সিগারেট ধরিয়েছিল’ বলে হাস্যকর স্ট্যাটাস দিয়ে, ‘পরিবেশ রক্ষার্থে সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দিয়েছেন যারা তারা নাকি পরিবেশরক্ষার্থে হরতাল করছেন’ – বলে আমরা আমাদের ভেতরকার শ্বদন্ত বের করে ফেললাম। অথচ কথা হবার কথা ছিল, ভাইরাল হবার কথা ছিল তার ‘মুখোমুখি’ ময়দানের লড়াইটাই!
তো দণ্ডধারী পুরুষরা, শুনে রাখুন- আমরা আপনাদের ধারণ করি। আমার ঐ গর্ভের বৃত্ত থেকে যোনিবৃত্তের ভেতর দিয়ে আপনারা বেড়ে ওঠেন, বের হয়ে পৃথিবীর আলো দেখেন। আমরা ময়দানে লড়াই করা মেয়ে। ‘বুয়াবৃত্তান্ত’ নিয়ে যদি আপনারা গর্বিত হতে পারেন, সারা মাসে মাসিক, মাসিক পূর্ববর্তী-পরবর্তী অবসাদ নিয়েও কাজ করার ফাঁকে সিগারেট ফুঁকে টিয়ার শেলের বিপরীতে ‘ময়দানে’ টিকে থাকা নিয়ে আমরাও গর্বিত হতে পারি!
মুমিতুল মিম্মা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]