ফারজানা আকসা জহুরা: একবার একজন নারী দু:খ করে বলেছিলেন যে, তার স্বামী তাদের ছোটো বাচ্চাটিকে খাওয়াতে পারেন না, একা একা বাচ্চাকে খাওয়াতে খাওয়াতে তিনি মাঝে-মধ্যে খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তিনি মনে প্রাণে চান যে, তার স্বামী যেই সময়টুকু বাড়িতে থাকেন, সেই সময়টুকু যেন বাচ্চা পালনে তাকে সাহায্য করেন। প্রতি উত্তরে অন্য নারী বলেছিলেন, যদি তার স্বামী অর্থাৎ বাচ্চার বাবা যদি তাদের বাচ্চাকে খাওয়ান, তারপরও তিনি তার বাচ্চাকে আবার খাওয়াবেন l কারণ তার বিশ্বাস, বাবা বাচ্চাকে ঠিক মতোন খাওয়াবেন না! আর তাই তার বান্ধবীর উচিৎ নিজের বাচ্চাকে নিজ হাতে খাওয়ানো !
আরেকবার আরেক নারী অভিযোগ করে বলছিলেন যে, তিনি যখন হাসপাতালে ছিলেন, তখন তার স্বামী তাদের বাচ্চাটির ঠিকমতো যত্ন করতে পারেননি, আর তাই তার ছোটো বাচ্চাটির ওজন কমে গিয়েছে !
সাধারণত আমাদের সমাজে বাচ্চার বাবারা কখনও আগ্রহী হয় না বাচ্চা লালন পালনে এবং ঘরের কাজে তার স্ত্রীকে কাজে সাহায্য করতে । যদি কখনও কেউ এই কাজে আগ্রহী হয়, তখন তার আশপাশের মানুষেরা তাকে উৎসাহ দেয়ার বদলে নিরুৎসাহিত করেন, বলে এটা হয়নি … এটা এইভাবে না, ওই ভাবে, ইত্যাদি। বাচ্চার বাবাদের নিয়ে আমাদের এই অবিশ্বাসই বাচ্চা পালনে অনেক বাবাদের নিরুৎসাহী করে তোলে, আর তাই তারা বাচ্চাকে খাওয়াতে আগ্রহী হোন না, আবার স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে বাচ্চা সামলাতেও চান না। এমনকি রান্নাঘর এলোমেলো হওয়ার ভয়ে যখন নারীরা চান না তার স্বামীটি রান্নাঘরে যাক, তখন আরাম প্রিয় পুরুষেরা কেনো কষ্ট করে রান্না করতে আগ্রহী হবে, বলুন তো?
আমাদের মনে রাখা উচিৎ, একজন নারী যেমন সন্তান জন্মদানের পরই সন্তান লালন-পালন আস্তে আস্তে শিখে যাই , ঠিক তেমনি একজন বাবাও বাচ্চা লালন-পালন করতে করতেই শিখতে পারে। যদিও বলা বাহুল্য যে, আমাদের সমাজের বাবারা বাচ্চার প্রতি তাদের ভালোবাসা খেলাধুলা আর উপহার সামগ্রী কিনে দেওয়াকে বোঝায়। এই সমাজে কয়জন বাবা আছেন যারা রাতে ঘুম নষ্ট করে বাচ্চাকে দুধ খাইয়েছেন? আর কয়জন বাবাই বা বাচ্চার হাগুর কাঁথা হাত দিয়ে ধুয়েছেন?
তবে আমাদের সমাজে যে যত্নশীল বাবা একেবারেই নেই, তা কিন্তু বলা যাবে না, আছে। আমার এক বান্ধবীকে বলতে শুনেছিলাম, তার বাবা গরমের সময় সারারাত তাদের পাখার বাতাস করে সকালে অফিস করতেন। কারণ তাদের ঘরে কোনো ফ্যান ছিলো না, আর প্রচণ্ড গরমে তারা ঘুমাতে পারতো না। আমার এক চাচাকে দেখেছিলাম, বাচ্চা হওয়ার পরে নিজেই কাঠের চূলায় রান্না করে বৌকে খাওয়াতেন। আমার এক দূর সম্পর্কের দাদা বৌ মারা যাওয়ার পরে আর বিয়ে করেননি, একাই ছেলেমেয়ে মানুষ করেছেন।
আর আমার বাবা প্রতি শুক্রবার আমার ছোটো দুই ভাইবোনের কাঁথাসহ সমগ্র বাড়ির কাপড় হাত দিয়ে ধুতেন। শুধু তাই নয়, আমার বাবা আমাদের ভাত খাওয়াতেন ও গল্প পড়ে ঘুমও পাড়াতেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েদের মশারি আমার বাবাই টাঙ্গিয়ে দিতেন। অন্ততপক্ষে আমি আমাদের চারপাশে এইরুপ অনেক যত্নবান বাবাদের দেখেছি ও তাদের কথাও শুনেছি।
আর এই আধুনিক বিশ্বে যেহেতু সমলিঙ্গে বসবাস ও বিয়ে বৈধ, তাই অনেক বাবাদের দেখা যায় যারা অনায়াসে বাচ্চা অ্যাডপ্ট করে সুন্দরভাবেই লালন পালন করছেন। এই তো সেদিন আমার ছোটো ছেলেটিকে টিকা দিতে গিয়ে দেখলাম দুইজন বাবাকে, তারা কী পরম যত্নে তাদের আদরের সন্তানটিকে নিয়ে এসেছেন ডাক্তারের কাছে। যখানে আমি একা গিয়েছি , সেখানে তারা দুইজনই এসেছেন ! অন্যদিকে এইসব দেশে এমন অনেক পরিবার আছে, যেখানে হয়তো নারীটি চাকরি করেন, আর পুরুষটি ঘরসংসার ও বাচ্চা দেখাশোনা করেন।
আর এই ধরনের পরিবেশে থেকে আমার সঙ্গীটিও সন্তানদের যত্ন নিতে একটুও ভুলেন না। যতটুকু সময় তিনি পান, সবটুকু সময়ই তিনি বাচ্চাদের যত্নে ব্যয় করেন। যত্ন বলতে মলমূত্র পরিষ্কার থেকে খেলাধূলা, রাতে উঠে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো থেকে ডায়াপার পাল্টানো সবই । এমনকি আমার প্রথম সন্তানের বয়স যখন ১৮ মাস , তখন তাকে নিয়ে আমার অসুস্থ শাশুড়ীকে দেখতে তিনি বাংলাদেশেও গিয়েছিলেন।
তার বক্তব্য ছিলো, যদি মা হয়ে আমি একা সারাদিন বাচ্চা সামলাতে পারি, তাহলে সে বাবা হয়ে কেনো পারবে না? তারও পারা উচিৎ! যেহেতু তখন আমি সাড়ে ছয় মাসের গর্ভবতী ছিলাম, তাই আমি আর তাদের সাথে যাইনি। ঐ ভ্রমণে তিনি মোট ১৪ দিন বাচ্চাকে একা সামলিয়েছেন , একই সাথে উপলব্ধি করেছেন যে, সারাদিন বাসায় বসে আমি কী কী করি!
ছোটো বাচ্চাকে নিয়ে তার এই বাংলাদেশ ভ্রমণ তাকে সন্তানকে বড় করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী করেছে। যদিও তার এই বাংলাদেশ ভ্রমণে অনেকেই অবাক হয়েছেন, তবে সবার অবাক হওয়ার কারণ এক না। অনেকে ভালো মনেই অবাক হয়েছে। কিন্তু অনেকেই ভাবতেই পারেননি যে, বাবা তার সন্তানের যথাযথ যত্ন নিতে পারে! কিভাবে আমি মা হয়ে আমার সন্তানকে বাবার হাতে ছেড়ে দিলাম?
এই আধুনিক সমাজে বসবাস করে এখনও আমরা চিন্তায় ও ব্যক্তি জীবনে একটুও আধুনিক হতে পারিনি। আমাদের যতো আধুনিকতা আছে, তা সবই পোশাক ও সুযোগ সুবিধা ভোগে ! এখনও আমরা ধরেই নেই সন্তান পালন শুধুমাত্র মায়েদের কাজ। আবার অনেক মা আছেন যারা ভাবেন যে, বাবা যেহেতু সন্তান জন্ম দেয়নি, তাই তারা বাচ্চা পালতেও পারবেন না? সন্তানের সকল ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা বাবাদের নেই, তা একমাত্র মায়েদের আছে।
আর মায়েদের এইরুপ রক্ষণশীল মানসিকতার কারণে অনেক সচেতন বাবাও সন্তানের যত্ন নিতে ভয় পান। এর ফল যা হয় , সারাজীবন মায়েদের একা একাই সন্তান লালন-পালন করতে হয়। আর তাই তারা সন্তানকে নিজের সম্পত্তি বলে মনে করেন, এবং তাদের উপর যত ধরনের অধিকার আছে, তা সবই প্রয়োগ করেন।
সন্তান যেহেতু দুইজনের, তাই দুইজনেরই উচিৎ সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব নেয়া। বাবা চাকরি করেন, এটা কোনো অজুহাত হতে পারে না। চাকরিজীবী মায়েরা যদি সারাদিন পরিশ্রম করেও বাসায় এসে বাচ্চা পালতে পারেন, তাহলে বাবারা কেন অবসরে ও ছুটির দিনগুলিতে বাচ্চা পালতে পারবেন না?