মনিজা রহমান: কেউ ভাবেনি। কেউ না। এমনকি যারা মারচ পাস্টে অংশ নিতে এসেছিল তারাও না। বতৃমান সরকার না। পুলিশ প্রশাসন না। নগর কর্তৃপক্ষও না। এমন এক অভূতপূর্ব জমায়েতের জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউ। পুরো ম্যানহাটান অচল হয়ে গিয়েছিল লাখো মানুষের উপস্থিতিতে।
ঘটনাটি গত ২১ জানুয়ারির। ফেসবুকে এক পোস্ট থেকে এমন দাবানল ঘটবে কারও কল্পনাতেও আসেনি। সকাল থেকে টিভি খুলে দেখছিলাম মানুষের প্রতিবাদী দৃশ্য। উদ্যোগ ছিল প্রধানত নারীদের। বক্তারাও বেশীরভাগ ছিল নারী। তবে সেখানে পুরুষ ও শিশুদের উপস্থিতি ছিল অভাবনীয়। স্ট্রলারে করে, বাবা-মায়ের কাঁধে করে এসেছিল শিশুরা।
ওইদিন ছিল আমার খুব ঘনিষ্ঠ দুইজনের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। দুপুরে সেখানে অনেক আনন্দ হলো। তারপর বড় ছেলেকে গানের স্কুল থেকে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মধ্যে কোথায় যেন একটা কাঁটা বিঁধে থাকলো মনে।
আমার তো যাওয়া হলো না মার্চে! আমার জীবনেরও তো অনেক বঞ্চনার কাহিনী ছিল। সাহসের অভাবে বলা হলো না। তবু তো ওখানে থাকলে একটু সাহস পেতাম। বুঝতাম, দেরী হোক-যায়নি সময়।
এলিভেটরে আমার প্রতিবেশী জেনকে দেখে আনন্দে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলো। পদযাত্রা প্রতিবাদে গিয়েছিল ও। হাতে প্ল্যাকার্ড। ওকে ছুঁয়ে দিয়ে দিনভর ঘটনা উত্তাপ নিলাম।
জেনের পুরো নাম জেনিফার থমসন। আমেরিকার নির্বাচনের আগের কথা। বাসায় টিভি দেখছিলাম। সিএনএনে হিলারি ক্লিনটনের ওপর একটা ক্যাম্পেইন ভিডিও দেখাচ্ছিল। হঠাৎ দেখি সেখানে আমার এক পরিচিত মুখ। প্রথমে চেনা মনে হলো। পরে বয়ফ্রেন্ডসহ দেখানোর পরে নিশ্চিত হলাম, ওরা আমাদের বিল্ডিংয়েই থাকে। পরবর্তী দেখায় জেনকে ভিডিওর কথা বলতেই ও খুব খুশী হল। ক্রমে পরিচয় গাঢ় হলো। জেনে খুব ভালো লাগলো, জেন হারভার্ড ইউনিভার্সিটির একজন গ্রাজুয়েট। বর্তমানে সে নিউইয়র্কের অন্যতম সেরা হান্টার কলেজের এসোসিয়েটেড প্রফেসর।
অত্যন্ত সচেতন একজন মানুষ সে। যেমন নিউইয়র্কের বাংগালী কমিউনিটির আরেক পরিচিত মুখ মেহেরুন্নেসা জোবায়দা। তিন শিশু সন্তানের লালন-পালন, ঘরে বাইরে এতো কাজ, তবু তিনি নিজেকে আটকে রাখতে পারেননি সংসারের ঘেরাটোপে। বহু কষ্ট করে সভাস্থলে গিয়েছিলেন। আবার বাসায় ফিরেছেনও বহু হয়রানির পরে। তার মধ্যে ঘন্টায় ঘন্টায় ফেসবুকে লাইভ করেছেন বিভিন্ন স্থানের। সাবওয়ে স্টেশনে থেকে শুরু করে পথে পথে পিঁপড়ার মতো মানুষের মিছিল দেখছিলাম বারবার।
এই বিক্ষোভের মূলকেন্দ্র ছিল ওয়াশিংটন ডিসি। সেখানে গত ২০ জানুয়ারি শপথ নিয়েছেন আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার অভিষেক অনুষ্ঠানে যতো মানুষ এসেছিল, তার পাঁচ গুণ বেশী মানুষ ছিল ২১ জানুয়ারি বিক্ষোভে। আসলে কোন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবার পরে এমন বিশাল প্রতিবাদ মিছিল-সভার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নেই।
পুরো ঘটনাই ছিল নজিরবিহীন। এভাবে ম্যানহাটান শহরকে অচল হতে দেখেনি কেউ। রাস্তায় এম্বুলেন্স-পুলিশের গাড়ী আটকে আছে মানুষের মিছিলের জন্য, আমেরিকার মানুষ কোনদিন দেখেছে কিনা সন্দেহ!
এই বিক্ষোভ শুধু ওয়াশিংটন আর নিউইয়র্কে নয়, ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। বোস্টন, ফিলাডেলফিয়া, সিয়াটল, অস্টিন, লস এ্যাঞ্জেলস কোথায় পথে নামেনি মানুষ। পথে নামে মানুষ লন্ডনে, প্যারিসে, সিডনিতে, টোকিওতে। ওয়াশিংটনে হাজির হয়েছিল সাত লাখেরও বেশী মানুষ। নিউইয়র্কে সাড়ে চার লাখ। ম্যানহাটানের ফোরটি টু স্ট্রিট থেকে ফিফটি ফাইভ পর্যন্ত ভরে গিয়েছিল মানুষে মানুষে।
অবাক হবার মতো বিষয় হলো, এই মিছিলের বেশীরভাগ মানুষ ছিল শ্বেতাংগ। যারা ট্রাম্পকে জিতিয়ে আনতে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়। কমিউনিটি এ্যাকটিভিস্ট মেহেরুন্নেসা জোবায়দা মাথায় হিজাবসহ ইসলামী পোষাক পরেন। ট্রেনে যাবার সময় অনেক শ্বেতাঙ্গ তার সঙ্গে ছবি তুলতে চেয়েছে। তার ভাষায়, শ্বেতাঙ্গদের কাছ থেকে এতোখানি সমাদর আগে কোনদিন পাইনি।
লন্ডনে যেমন বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিলেন মেয়র সাদেক খান ও তার স্ত্রী সাদিয়া খান। কারণ এই বিক্ষোভ মানবাধিকারের। সমান অধিকারের। সব বর্ণের, সব ধর্মের মানুষকে এক চোখে দেখার। এই বিক্ষোভ পারিবারিক সহিংসতা-যৌন হয়রানির বিরুদ্ধেও। এই কথা আমার প্রতিবেশী জেনেরও। ওর পূর্বপুরুষ ফিলিপাইন থেকে এসেছিল। ওর সঙ্গী একজন পুয়েতরিকান। স্বাবলম্বি বলেই জেন অর্জন করতে পেরেছে ভিন্ন মহাদেশের, ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির একজন মানুষকে জীবনসঙ্গী করার সাহস।
নির্বাচনী প্রচারণায় নারীদের নিয়ে অত্যন্ত অপমানজনক কথা বলেছেন ব্যবসায়ী ট্রাম্প। আত্মসচেতন মানুষ হিসেবে অনেকে সেটা মেনে নিতে পারেনি। পুরো বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল কোন রাজনৈতিক দল কিংবা কোন সংগঠনের ব্যানার ছাড়াই। তবু অপরিকল্পিত সেই কর্মসূচিই গড়লো ইতিহাস। যে ইতিহাসের সাক্ষী হতে এসেছিলেন আমেরিকার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, সংগীতশিল্পী ম্যাডোনা, কেটি পেরি, অভিনেত্রী স্কারলেট জনসন, এ্যাশলে জুড, আমেরিকা ফেরেইরা, সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন, পরিচালক মাইকেল মুরসহ অনেকে।
সাংবাদিক, লেখক