“আসল কথা সামনে যাবো, রইবো না কেউ পিছে”

মোহছেনা ঝর্ণা: আজ থেকে ২০/২৫ বছর আগে কর্মক্ষেত্রে আমাদের অগ্রজ নারীগণ যে সমস্ত প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন, এতোদিন পর এসে তাদের মুখেই যদি আমাদেরকে শুনতে হয়, আমরা কষ্ট করেছি না, তাহলে আপনারা কেন করবেন না? তারপরও আপনারা তো অনেক ভালো আছেন, আমরা আরও অনেক বেশি কষ্ট করেছি, আমাদের কষ্টের কথা কারও কাছে বলার মতো মানুষও ছিল না।

যারা এমন কথা বলেন, তাদের জন্য আমার দু:খ হয়, কারণ এতোটা সময় ধরে তারা কেবল হেঁটেই গেছেন, পথ তৈরি করতে পারেননি। যে কষ্ট আজ আমি করবো, ২০/২৫ বছর পর একই কষ্ট যদি আমার উত্তরসুরিকেও করতে হয়, তাহলে আমার এই পথচলা পুরাটাই তো বৃথা। আমি কষ্ট করেছি বলেই তো আমার উত্তরসুরি তার সুফল পাবে।

মোহছেনা ঝর্ণা

সবাইকে যদি এক বিন্দু থেকেই শুরু করতে হয়, তাহলে কি আর পথ এগোবে? যেখানে আমার শেষ, সেখান থেকেই হবে আমার উত্তরসুরির শুরু। এমন একটা বিষয় একটুও লিখতে চাচ্ছিলাম না। কারণ “মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু” এই কথাটা কোনোভাবেই মানতে চায় না মন। আর চাইবেই বা কেন? কিন্তু প্রায়োগিক প্রেক্ষাপটে যখন এ কথার সত্যরূপ নির্মমভাবে চোখে ধরা পড়ে এবং হাজার বার আড়াল করে রাখার প্রয়াস যখন ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন মনে হয়, আচ্ছা কেন আমরা নিজেরা নিজেদের সহযোদ্ধা না ভেবে প্রতিপক্ষ ভাবি? কেন নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বাহ্যিক দ্বন্দ্ব তৈরি করে আমাদের অমসৃণ পথটাকে আরো বেশি অমসৃণ করে তুলি?

কোথাও দুটি মেয়ে বা তিনটি মেয়ে একসাথে কাজ করতে গেলে ছেলেরা টিপ্পনী কেটে কেন বলবে, এখানে আমাদের কিছু করতে হবে না। ওরা ওরাই কিছুক্ষণ পর চুলোচুলি লেগে যাবে। আমরা বান্ধবীরা মিলে কখনও কোথাও আড্ডা দিলে অনেক গল্পের মধ্যে কর্মজীবনের গল্পও চলে আসে। তখন দেখা যায় প্রায় সবার মুখেই একই ধরনের অভিযোগ, অনুযোগ। বিশেষ করে বস যদি নারী হয়, তাহলে জীবন শেষ। অথচ হওয়ার কথা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমরা মেয়েরা প্রায়ই ওয়াশরুমের সমস্যায় পড়তাম। পানির সমস্যা, অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্নতা। আমাদের ডিপার্টমেন্টের ম্যাডাম শামীমা হায়দার একদিন আমাদের মেয়েদের ওয়াশরুমের সমস্যার কথা শুনে বলেছিলেন, প্রশাসনের উচ্চপদে মেয়েরা নেই তো, তাই সমস্যাগুলোর সহজ সমাধানও কঠিন হয়ে যায়। কারণ ছেলেদের পক্ষে তো মেয়েদের সমস্যা পুরোপুরি উপলব্ধি করা সম্ভব না।

অন্যদিকে, মেয়েরা তো খুব সহজেই মেয়েদের সমস্যা বুঝতে পারে। কিন্তু কর্মজীবনের পথ চলতে গিয়ে দেখছি সম্পূর্ণ বিপরীত। যেমন মেয়েদের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি কটু কথা শুনতে হয় মেয়েদের থেকেই। যারা একসময় অনেক কষ্ট করেছিলেন। সরকারি ভাবে মাতৃত্বকালীন ছুটি দু’মাস, তিন মাস থাকার কারণে যারা নিজের বাচ্চাদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেননি, তারাই যখন চোখ কপালে তুলে বলে, মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস!! কেন আমরা দু’তিনমাস ছুটি নিয়ে বাচ্চা মানুষ করিনি? তাহলে এখন ছয় মাস ছুটির কী দরকার?

বেশ কিছুদিন আগে একটা টকশোতে নারীনেত্রী শিরীন আখতারের একটা বক্তব্য শুনেছিলাম মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে। তিনি বলেছিলেন, তার প্রথম সন্তান ছিল সিজারিয়ান বেবী। এই ছেলের ১৫ দিন বয়সের সময় তাকে তার কাজের জন্য ছুটে যেতে হয়েছিল বিভিন্ন জায়গায়। ছেলেকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেননি তিনি। যে কারণে ছেলের মনে এখনও অভিমান জমে আছে।

তারপর বললেন, ‘আমি কাজ করতে গিয়ে অনুধাবন করেছি মাতৃত্বকালীন ছুটির সময় বাড়ানো কতটা জরুরি। দিনের পর দিন আমরা আন্দোলন করে গেছি মাতৃত্বকালীন ছুটির সময় বাড়ানোর জন্য। এখন তো সরকার ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি মঞ্জুর করেছে। শিরীন আখতারের সেই বক্তব্য শুনে আমার বারবার মনে হচ্ছিল, তারা যদি ভাবতেন, আমার সময়ে আমি কষ্ট করেছি, তাহলে অন্যরা কেন এখন ছয় মাস ঘরে বসে বসে বাচ্চাকে আদর করবে, যত্ন করবে, সময় দেবে, তাহলে ভাবুন তো কী দশা হতো আমাদের?

ভাগ্যিস শিরিন আখতাররা গতানুগতিক ভাবনায় গা ভাসাননি। কোনো পথই একদিনে তৈরি হয় না। বিন্দু বিন্দু করেই যেমন সিন্ধু গড়ে ওঠে, ঠিক তেমনি ঘাসের উপর হাঁটতে হাঁটতেই একদিন ঘাসের মাঝখান দিয়ে সরু একটা পথের রেখা তৈরি হয়। সাপের মতো আঁকা-বাঁকা। অথচ পথ চলতে চলতে এবং পথের দাবি মেটাতে মেটাতে একদিন সে পথই হয়ে যায় এক একটি গ্র্যান্ড ট্র্যাংক রোড।

এমনিতেই সমস্যার অন্ত নেই, তার মধ্যে আমরাই যদি নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াই, তাহলে তার এগোতে হবে না, স্থির হয়ে একই বিন্দুতে বরফ-পানি খেলার মতো বরফ হয়ে থাকতে হবে। তাই আর নিজেরা নিজেদের প্রতিপক্ষ না হয়ে সহযোদ্ধা হিসেবে যেন চলতে পারি, একে-অন্যের সুখ-দুঃখের অংশীদার যেন হতে পারি, আমাদের ভেতর যেন সেই শুভ বোধের উন্মেষ ঘটে।

আসল কথা হচ্ছে, ঘরে-বাইরে ,নারী-পুরুষ সবাই মিলেই আমরা যাবো, কেউ পিছনে পড়ে থাকবো না, আর সেজন্যই দরকার একে অন্যের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। কর্মক্ষেত্রগুলো নারীদের নিরাপদ এবং স্বস্তিদায়ক অভয়ারণ্য হয়ে উঠবে এই প্রত্যাশা।

শেয়ার করুন: