মাতৃত্ব কি নারীর ক্যারিয়ারের অন্তরায়?

মোহছেনা ঝর্ণা: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবে দেখা হয়েছে অনেক বন্ধু-বান্ধব, সিনিয়র ভাইয়া, আপু, জুনিয়র ভাই-বোনদের সাথে। দারুণ কিছু সময় কাটিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম আমাদের অনেক মেয়ে বন্ধু অনেক ভালো ভালো জায়গায় কাজ করছে।

কেউ শিক্ষকতা করছে, কেউ বিসিএস ক্যাডার হয়েছে, কেউ ব্যাংকে কাজ করছে, কেউ এনজিওতে আছে, অনেকে ব্যবসা করছে, নারী উদ্যোক্তা হয়েছে, নিজের পাশাপাশি অন্যের কর্মসংস্থানও করছে, শুনতেই ভালো লাগছিল। তবে পাশাপাশি আবার যখন শুনলাম বাচ্চা হওয়ার পর কাউকে কাউকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছে, তখন খারাপই লাগলো।

মোহছেনা ঝর্ণা

আমার ডিপার্টমেন্টের এক ছোট বোন একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করতো। বাচ্চা হওয়ার পর মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে অফিসে ফিরেই দেখা দিল সমস্যা। বাচ্চার অসুখ, বাসায় ফেরার তাড়া, ঘন ঘন ছুটির প্রয়োজন, সব মিলিয়ে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছিল। তারপর অনেক কষ্ট করে পাওয়া চাকরিটাই ছেড়ে দেয়ার কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। বললো, বাচ্চাকে নিজের হাতে যত্ন করছি, খাওয়াচ্ছি, গোসল করাচ্ছি, খেলছি, সবই ভালো লাগছে, কিন্তু যখন মনে হয় আমার নিজের একটা জীবন ছিল, নিজের একটা পরিচয় ছিল, তখন স্বাভাবিকভাবেই মনটা খারাপ হয়।

আমার এক বান্ধবীরও একই সমস্যা। বাচ্চা হওয়ার পর বাচ্চা রাখার বিড়ম্বনায় শেষ পর্যন্ত চাকরিটাই ছেড়ে দিয়েছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পর ছুটির প্রয়োজন বেশি ছিল। এছাড়া আজ এক বাচ্চা অসুস্থ, তো কাল অন্য বাচ্চা। সব মিলিয়ে বেসামাল হয়ে যাওয়ার দশা। অবশেষে চাকরিটাই ছেড়ে দিল। আমার সঙ্গে দেখা হলেই বলবে, তোদেরকে দেখলে ভালোও লাগে, কষ্টও লাগে। ওর বিষণ্ণতা বুঝতে পারি। ও প্রায়ই বলে, আমরা নারীর উন্নয়ন নিয়ে মিটিং করি, সমাবেশ করি, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আন্দোলন করি, কিন্তু নারী উন্নয়নের একটা বড় প্রতিবন্ধকতার সমাধান কেউ খুঁজতে চাই না।

একটা মেয়ে যখন মা হয় তখন থেকে তার জীবনটা আর শুধু তার একার থাকে না। সে যেখানেই থাকুক না কেন, যে কাজই করুক না কেন, মনটা পড়ে থাকে সন্তানের কাছে। কেমন আছে আমার সন্তান? কী করছে? কী খাচ্ছে? নিরাপদে আছে তো?

কয়েক বছর আগে একবার চট্টগ্রামের পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি দুই- আড়াই বছরের ছোট্ট একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে মা কাঁদছে। অনেক্ষণ বসে থাকতে থাকতে একটা সময় গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছেন কেন? ভদ্রমহিলার শুনে আমার নিজেরই কান্না চলে আসলো।

মহিলা গার্মেন্টসে কাজ করে। নিজের মায়ের কাছে বাচ্চা রেখে প্রতিদিন কাজে যেতেন তিনি। মহিলার মা দু’দিনের জন্য গ্রামে গিয়েছিল দরকারি কাজে। সেই দুদিন ভদ্রমহিলা প্রতিবেশির বাসায় বাচ্চা রেখে কাজে গিয়েছিল। একদিন রাতে বাসায় ফিরে দেখে বাচ্চার ডান চোখটা লাল হয়ে আছে। জানতে পারলো, বাচ্চা দুষ্টুমি করতে করতে প্রতিবেশির পানের বাটা থেকে চুন নিয়ে চোখে লাগিয়ে ফেলেছে। কিন্তু প্রতিবেশি তা খেয়াল করেননি। চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে জানতে পারলেন, বাচ্চাটার ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। কারণ ডান চোখে চুন ঢুকে গিয়েছিল।
কী ভয়াবহ সংবাদ! সামান্য অসাবধানতায় একটা চোখ অন্ধ!

এ প্রসঙ্গে বলাই যায়, কয়েক বছর আগে আমার এক সহকর্মী বাসায় শাশুড়ির কাছে ছোট বাচ্চা রেখে আসতেন। শাশুড়ির বয়স অনেক বেশি ছিল এবং তিনি অসুস্থ ছিলেন। তাই ছোট বাচ্চা রাখা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেজন্য সেই সহকর্মী একজন গৃহ পরিচারিকা রেখেছিল শুধু বাচ্চাকে দেখাশোনা করার জন্য। অফিসে আসার পর থেকে তিনি একটু পরপর অন্যমনস্ক হয়ে যেতেন। আমরা জিজ্ঞেস করলে বলত, বাথরুমের দরজাটা লাগিয়েছে তো মেয়েটা, রান্নাঘরের ছিটকিনিটা দিয়েছে কিনা, আমার বাচ্চাটা হিসু করে ভেজা প্যান্ট পরে আছে কিনা, ঠিকমতো খেয়েছে কিনা এগুলো না সারাক্ষণ মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। যদি অফিসে বাচ্চা রাখার একটা জায়গা থাকতো, তাহলে আর এত অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হতো না।

প্রায় দশ বছর আগে আমার সেই সহকর্মীর কথা এখন আমার প্রায় মনে হয়।
আমার মা গ্রামের বাড়িতে গেলে আমার অবস্থাও এখন সেই সহকর্মীর মতোই হয়ে যায়।

ইদানীং খাবার রেস্তোরাতে গেলে দেখা যায়, ছোট্ট একটা জায়গার মধ্যে আরো ছোট্ট পরিসরে কিডস কর্নার নামে একটা জায়গা রাখা হয়। যেখানে একদম ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে ছয়- সাত বছর বয়সী বাচ্চারা পর্যন্ত খেলতে পারে। এট নাকি রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের একটা কৌশল। বাবা- মা, কিংবা বড়রা খাওয়া-দাওয়া করল, গল্প করলো, বাচ্চারাও চোখের সামনে খেললো, দারুণ একটা আইডিয়া। ছোট ছোট বাচ্চার বাবা- মায়েরা সেই কোন দূর থেকে কিডস কর্নার থাকা রেস্টুরেন্টে আসে খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি বাচ্চাদের আনন্দ দেখার জন্য। বড় বড় শপিং মলগুলাতেও এখন বাচ্চাদের খেলার জায়গা রাখে।

শুধু চাকরি করা মায়েদের বাচ্চাগুলো রাখার জন্য, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য চাকরির প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ কোনো ব্যবস্থা না থাকায়, যারা চাকরি করে তারা কাজের ফাঁকে ফাঁকে সন্তানের কথা ভেবে প্রায় সময় অন্যমনস্ক হয়ে যায়। আর যারা অন্যমনস্কতার চাপ নিতে পারে না তারা চাকরি ছেড়ে দেয়াটাই উত্তম মনে করে, কখনো কখনো বিষণ্ণতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়।

এই দোলাচলের জীবনে মনের ভেতর খচখচ করতে থাকে, তবে কি মাতৃত্ব, নারীর ক্যারিয়ারের অন্তরায়?

শেয়ার করুন: