‘উইমেন মার্চ’ থেকে আমরা কী শিক্ষা পাচ্ছি?

কাজল দাস: সমীকরণ ছিল সারা বিশ্বের সামনে আমেরিকা প্রথমবারের মতো একজন নারী প্রেসিডেন্ট উপহার দেবে। বিপরীতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বিতর্কিত রাজনীতিবিদ থাকায় এই হিসাব আরও জোরালো হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তা হয়ে উঠেনি। তবে আমেরিকা একজন নারী প্রেসিডেন্ট দিতে না পারলেও, সারাবিশ্বের নারীদের জন্য এক অনন্য ও অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত তৈরি করলো  ট্রাম্পবিরোধী ‘উইমেন মার্চ’ এর মধ্য দিয়ে।

বিশ্বের সবার নজর এখন এই মার্চের বিশালতার দিকে। স্মরণকালে নারীদের এতোবড় সমাবেশ দেখা যায়নি।

ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এই সমাবেশে প্রায় ২৯ লাখ লোক রাস্তায় নেমেছেন। এটা আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণ-সমাবেশ বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শুক্রবারে ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের পরের দিন শনিবারে আমেরিকার ৫০টি রাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় শহরে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নারীদের এই মার্চ অনেকদিক থেকেই ঐতিহাসিক

১৯৯৩ সালে সমকামী অধিকার আন্দোলনে লোক ছিল আট লাখ থেকে এক মিলিয়ন, ১৯৯৫ সালে মিলিয়ন ম্যান সমাবেশে লোক ছিল চার থেকে ১১ লাখ,  ১৯৮২ সালে পরমাণু চুক্তিবিরোধী জনসভায় লোক ছিল- ১০ লাখ, ১৯৬৩ সালের সিভিল রাইটস আন্দোলনে লোক ছিল-আড়াই লাখ, ১৯৬৯ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে লোক ছিল পাঁচ থেকে ছয় লাখ। (সূত্র: http://www.politicususa.com/)।

কিন্তু এই আন্দোলন আগের সকল উপস্থিতির রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এবং এই যে বিশাল সমাবেশ হলো তাঁর অগ্রভাগে আছেন আমেরিকান নারীরা। এই প্রতিরোধের ভারকেন্দ্র নারীদের হাতে। তাঁর পরবর্তি পদক্ষেপ কী হবে তা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে; কিন্তু এটি পরিষ্কার যে, আমেরিকার নারীরা স্পষ্টত: ট্রাম্পের বিভিন্ন বক্তব্য, মন্তব্য আর কটুক্তির বিরুদ্ধে জবাব দিতেই রাস্তায় নেমেছেন।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই নারীরা ডেমোক্র্যাটদের সমর্থিত। এবং নানান কারণে অ্যান্টি ট্রাম্প ইজ অ্যা ফ্যাক্টর। কিন্তু এই নারীরা এবং তাঁদের সাথের পুরুষেরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন সমান তালে। আন্দোলনকারীরা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছেন তাঁর মধ্যে অনেকগুলো বিষয় আছে। জেনোফোবিয়া, ইসলামোফোবিয়া, সেক্সিজম, অ্যাবরশন রাইট, হিউম্যান রাইট, কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, তাঁর উচ্চ শ্বেতাঙ্গ মনোভাব,  খুবই পক্ষপাতিত্বপূর্ণ  মন্ত্রিসভা গঠন এইসব বিষয় নিয়ে এই সমাবেশ থেকে ভয়েস রেইজ করা হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনের মূল স্পিরিট এসেছে ট্রামের নারীবিদ্বেষী বক্তব্যের জবাব দেয়ার জন্য। এবং এই বিষয়টি উইমেন মার্চের সভানেত্রী গ্লোরিয়া স্টেইনেইম এর বক্তব্য থেকেও উঠে এসেছে, তিনি মার্চের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বলেছেন-  “Thank you for understanding that sometimes we must put our bodies where our beliefs are,” এমনকি সমাবেশে অংশগ্রহণকারী সব নারী, উপস্থিত সহযোদ্ধা পুরুষ সবাই বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডের বক্তব্যের মধ্য দিয়েও এই ‘নারী অবমাননার’ বিষয়টিই সামনে নিয়ে এসেছেন।

উইমেন মার্চ দেখার পর একটা বিষয় মাথায় ঘুরছে। তাহলো, আমাদের দেশে কেন এরকম কোনো মার্চ বা র‌্যালি আমরা দেখতে পাই না? এখানে তো নারী অবমাননাকর ইস্যুর কোনো কমতি নেই। তাহলে কি নারী আন্দোলনকারীরা একতাবদ্ধ নন?

আমাদের উচিত এই নারীদের থেকে একটা বিষয়ে শিক্ষা নেয়া, আর সেটা হলো নারী অবমাননাকর সিদ্ধান্ত যদি রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত হয়, যদি কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নেতা নারীদের অপমান করে বক্তব্য দেয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে যুৎসই প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

হেফাজত নেতা শফি হুজুর প্রকাশ্যে নারীদের নিয়ে খুব অবমাননাকর ভাষায় কথা বলেছেন। তাঁর আগে চরমোনাই পীরসহ তার মুরীদরা তাদের প্রতিটি বক্তব্যেই নারীবিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন। কিন্তু কষ্টকর যে, নারী সমাজ বা সুশীল সমাজের উদ্যোগে তেমন কোনো সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি এসবের প্রতিবাদে। এই প্রতিরোধ করতে না পারার সুযোগেই এই রকম একজন নারী বিদ্বেষী ধর্মীয় নেতা এখন সরকারের সাথে বন্ধুভাবাপন্ন অবস্থানে আছেন। আমাদের দরকার ছিল এই ব্যক্তির যথোপযুক্ত শাস্তির পাশাপাশি তাঁকে আশ্রয়দানকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও কথা বলা।

এর আগে আমরা এইসব ধর্মীয় নেতাদের বিরোধিতার কারণে সরকারের কাছ থেকে একটি নারী নীতি আদায় করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি। তারা সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের ঘোরতর বিরোধী, সন্তানের পরিচয়ের ক্ষেত্রে সবসময়ই পিতৃ প্রাধান্য রাখতে চায়। নারীদের এসব বিষয়ে আরও কঠোর হয়ে উঠা উচিত।  

এমনকি শিক্ষানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি তারা হস্তক্ষেপ করে যাচ্ছেন নিয়মিত। ২০১৭ সালের পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপক আকারে সাম্প্রদায়িক পরিবর্তন, নারীকে খুবই স্টেরিওটাইপ করে উপস্থাপন করা, বিভিন্ন অসাম্প্রদায়িক টেক্সট বাদ দিয়ে তারা খুব প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা আজও পালন করে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধেও নারীদের সম্মিলিত প্রতিবাদ আসা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তেমনটি চোখে পড়ছে না।

বর্তমান সরকার কিছুদিন আগে বাল্যবিবাহ বিষয়ক আইন পাশ করিয়ে নিয়েছে সংসদীয় কমিটিতে, চলতি অধিবেশনে যা চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায়। সেই আইনে বিশেষ ক্ষেত্রে বয়স ১৬ বছর রাখা হয়েছে। ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে ৬৬% মেয়ের বিয়ে ১৮ বছরে আগে হয়ে যায়, এমনকি যে সকল মেয়ের বয়স  ২০ থেকে ২৪ বছর, তাদের  মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগের বিয়ে  ১৫ বছরের আগেই হয়ে যায়।  (সূত্র: http://www.unicef.org/bangladesh/children_4866)

শুধু তাই নয়, কেন মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দেয়ার আইন পাশ হচ্ছে, এই নিয়ে যুক্তিও দেয়া হচ্ছে যে- যদি কোন মেয়ে অল্প বয়সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে, তাহলে এই রিস্ক কে নেবে বা কারো দ্বারা ধর্ষিত হয়ে যদি গর্ভবতী হয়, সেক্ষেত্রে কী করা হবে? এই সব প্রশ্নকর্তারা এর উত্তরে যা বলছেন তা গোটা নারী সমাজের জন্য খুবই অমর্যাদাকর। তাঁরা বলেন-উপযুক্ত ক্ষেত্রে ঐসব মেয়েদেরকে যেকোন ভাবে বিয়ে দিতে হবে, এমনকি ধর্ষকদের সাথে হলেও তাই করতে হবে।

একথা বলার পর নারী অধিকার আদায়ে আন্দোলনকারীদের এইসব পুরুষতান্ত্রিক মজ্জাগত লোকদের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান কই?

আমাদের নারীদের উচিত ছিল, এবং এখনও সময় আছে, এইসব আইনের বিরুদ্ধে গণ-সমাবেশ গড়ে তোলা। উইমেন মার্চ যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

এইদেশে প্রতিদিন শয়ে শয়ে নারী ধর্ষিত হন। তনু ধর্ষণ এবং হত্যার মতো ঘটনায় নারীদের  রীতিমতো গণ-আন্দোলনে যাবার কথা ছিল। কিন্তু তা হলো কই? কেন হচ্ছে না, এটা এইদেশের নারী আন্দোলনের কর্মী, লেখক, সহযোগী সবারই ভাবার বিষয়।

নারী অধিকারের জন্য আন্দোলন মূলগতভাবে আগে নারীদেরই দাঁড় করাতে হবে। এই যে আমেরিকান নারীরা এতো বড় সমাবেশ করেছেন, সেখানেও সব নারী একাত্ম ছিলেন না। এক্সিট পুলের জরিপ বলছে, প্রায় ৫৩% নারী ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। এটা যেমন সত্য, তেমনি এই নারীদের দ্বারাই প্রায় ২৯ লাখ মানুষের সমাবেশ হয়েছে। তারা জোরালো কন্ঠেই ট্রাম্পের বিপরীতে তাদের মতামত জানিয়েছেন।

কাজল দাস

আমাদের দেশে নারীদেরকেও এই জায়গা থেকে চিন্তা করতে হবে। তাঁরা কেন একজন শফি হুজুর বা তাঁদের দেয়া ফতোয়া মেনে নেবেন, তাঁরা কেন মেয়েদের জন্য অবমাননাকর বিয়ের বয়স মেনে নেবেন, তাঁরা কেন একজন সাংসদের এই রকম অপমানজনক বক্তব্য মেনে নেবেন?

আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত সামাজিক মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে যেভাবে নারীকে অবমাননাকর পরিস্থিতিতে ফেলা হয়, অপমানসূচক বক্তব্য দেয়া হয় বিভিন্ন ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ, এমনকি রাজনীতিকদের কাছ থেকেও, মি. ট্রাম্প নিঃসন্দেহে তাঁদের মতো বক্তব্য দেননি। কিন্তু সেটা যেমনই হোক, আমেরিকার আত্ম-মর্যাদাসম্পন্ন নারীরা তা মেনে নেননি।

তাঁর জবাব তাঁরা দিয়েছেন ‘উইমেন মার্চ’ করে। যার মূলকেন্দ্রে ছিলেন নারীরাই।

এইদেশে আমাদের যারা নারী অধিকার কর্মী, যারা নারীবাদী লেখক, যারা জেন্ডার সেনসিটিভ, এদের সবার মূল কাজ হলো আন্দোলনের ভারকেন্দ্র নিজেদের হাতে নেয়া।

আপনি দাতা সংস্থার হয়ে কথা বলেন, আর যাই করেন, আপনার মনে রাখা দরকার সমঅধিকারের আন্দোলন ফান্ডিং করে আন্দোলনের বিষয় নয়, এটি নারীর মর্যাদার প্রশ্ন। আপনার দ্বারা পুরুষতন্ত্রের জোয়াল যেন শক্তিশালী না হয় সেজন্য আপনার সকল প্রজ্ঞা, আপনার অর্জন, আপনার সৃজনশীলতা সবকিছুকে দিনশেষে পিতৃতন্ত্রের সাথে তফাতে রাখেন। আমাদের সবারই ভাবা দরকার একজন নারীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা উদযাপন কখনোই সুখকর হতে পারে না, যতদিন ‘নারী’ শব্দটি একটি অপমানজনক ধারণার মধ্যেই থেকে যাবে।

শেয়ার করুন: