লুকানো ডায়েরি থেকে- ১১

চেনা অপরিচিতা: আমার মাতৃত্বসুলভ কোন অভিজ্ঞতা নেই। না আছে যত্নআত্তি করার অভ্যাস। আমি শুধু ভাবি আর অবাক হই। আমিও একটা মানুষ, আমারও নাকি বাচ্চা হবে। আমার একটা পোষা বিড়াল ছিল, সে তার বাচ্চা হওয়ার পর আমাদের সামনে তার বাচ্চা একটা একটা করে জড়ো করে দেখাতো, তা সে যত গভীর রাত হোক, চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করতো।

আমারও হয়তো তাই ইচ্ছে করলো, রক্তের মানুষদের জানাই। ভাইকে লজ্জায় ঢেকেঢুকে খেয়ে এসএমএস করলাম। ভাই জিজ্ঞাসা করলো, বাবা-মা’কে জানাবে কিনা! কেন যেন একটা অদৃশ্য ভয় আর কুণ্ঠায় বলতে নিষেধ করলাম। আমার চোখে মনে তাদের ঘৃণা ভরা চাউনি দপ দপ করছিল।

পরে ভাইয়াও বাবার বাড়ি যেতে নিষেধ করলো। আমার মা বিভিন্ন হুজুরের নানা তদবির ফলো করে। হয়তো কিছুই করবে না। কিন্তু মা হিসেবে আমার প্রিকশান নিতেই হবে। যদি ক্ষতিকর কিছু খাইয়ে দেয়! আমি তাদের আর জানালাম না। যোগাযোগও করলাম না। যদি বুঝে যায়!

কিন্তু তারা জানলো। আমার খালা জানালো, প্রাক্তন প্রতিবেশী খালাও বললো, বড় অনুনয় করে, এই অসহায় অবস্থায় আমাকে নিয়ে আসতে তাদের কাছে। কিন্তু আমার মা পিঠ ঘুরিয়ে বললো, এতে তাদের কিছু করার নেই।

তবে একবার আম্মা ফোন করেছিল। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, আমি কি অসুস্থ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তারপর বাসায় আসতে বললো। আমি ভয়ে আর যাইনি। যেখানে পরিষ্কার – আমার বিয়ে অবাঞ্ছিত, আমার স্বামী ঘৃণিত, আমি যৌন ক্ষুধায় কাতর, ঘর পালানো মেয়ে, যার তখন পর্যন্ত বিয়ের চেষ্টা চলছে, সেখানে আমি আমার অনাগত সন্তানকে নিয়ে গিয়ে বিপদ বাড়াতে পারবো না।

ঘৃণা করা আর ক্ষতি করতে চাওয়া- এ দুটো যেখানে বর্তমান, সেখানে আমার যতো কষ্টই হোক, আমি যাবো না।

হয়তো এটাই হওয়ার ছিল। আমি হয়তো জানতাম। কারণ আমার চাকরির সময় জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, আমার নিজের কামাই করা ব্যাংকের টাকা তোলার কাগজপত্র সব তারা আটকে রেখেছিল। শুধু বাসা ছাড়বার সময় একটা সুক্ষ্ম আশংকায় পড়াশোনার সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে বেরিয়েছিলাম। আর ব্যাংকের কাগজ বাদে অন্যগুলো নতুন করে তুলতে হয়েছিল, অনেক হাঙ্গামা করে। ব্যাংকের কাগজ আজও জোটেনি।  

যাই হোক, এই ঘটনায় নতুন করে তবু কেন এতো আঘাত পেলাম জানি না। হয়তো সব মা’ই সন্তানের প্রতি অবহেলা সইতে পারে না।

আমি চুপ করে রইলাম। আমার সব শারীরিক-মানসিক কষ্ট চেপে অফিসের কাজ সামলে মাঝে মাঝে অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস খেতে মন চাইতো। তখন আশে পাশে থাকা মানুষরা আমাকে সাহায্য করতো। একবার তরমুজ খেতে এমন মন চাইলো! কিন্তু সেই তরমুজ বহন করা আমার শারীরিক অবস্থায় একটা বিরাট ঝামেলা। লজ্জার মাথা খেয়ে আমার এক আঙ্কেলকে বললাম। উনি আমার জন্যে নিয়ে আসলেন। কী যে শান্তি পেয়েছিলাম সেই তরমুজটা খেয়ে!

আমার এই সময়টায় আমার শাশুড়ি আর ননাস-ননদরা যে যত্ন করেছে তা আমার জন্য সত্যি অবিশ্বাস্য। আমার বাবা-মা’ই নাজুক অবস্থায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আর সেখানে রক্ত সম্পর্কহীন কিছু মানুষ, হোক সে বৈবাহিক সূত্রের, সর্বক্ষণ খোঁজ রাখছে আমি কী খেতে চাই, কী খাবো, মুখের কাছে খাবার রেখে খেতে সাধছে, কখন হাঁটতে হবে বলে দিচ্ছে ইত্যাদি। হোক তাদের বংশের সন্তান আসছে সেজন্য, কিন্তু এতোটা আন্তরিকতা আমার মতো অভাজনের জন্য চোখে পানি আনার মতো।

আমি যখন চাকরি থেকে ম্যাটারনিটি লিভে যাবো, আমি ভেবেছিলাম, বাচ্চা হওয়ার পর এক আত্মীয়ার বাসায় থাকবো। সে আমার একমাত্র আত্মীয়া যে আমাকে বিয়ের পর থেকে সবচেয়ে মেন্টাল সাপোর্ট দিত। আমি তাকে সেই  অধিকারে বললাম, বাচ্চা হওয়ার পর মাস তিনেক তার কাছে থাকবো। সে মুখের উপর মানা করে দিল। বড় আঘাত পেলাম নতুন করে। আমার বাচ্চা হবে, কিন্তু আপন কারো কাছে থাকার জায়গা নেই।

যাই হোক, আমার এই নাজুক পরিস্থিতিতে যারা বিন্দু পরিমাণ সহযোগিতা করেছিলেন, তাদের ঋণ আমি কখনই শোধ করতে পারবো না।

তবে, আমি আমার মায়ের জন্য অপেক্ষা করতাম। আমি ভাবতাম, কখনও সে তার ইগো ভুলে আমার কাছে ছুটে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে নেবে, আর আমি দাঁত চেপে যে যন্ত্রণার পথ পাড়ি দিয়েছি, তা সাঙ্গ হবে।

ডেলিভারির দিন যতো ঘনিয়ে আসে, আমার বড় ভয় হয়। আমাকে শক্ত করে ধরে রাখবে, আমার পাশে থাকবে, সাহস যোগাবে, যার উপর নির্ভর করতে পারি এমন কেউ নেই। আমার পানি ভাংলে কে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে দৌড়াবে? কখন সেই মুহূর্ত আসবে সেটা কিভাবে বুঝবো? আমি সিদ্ধান্ত নেই সিজার করাবো। নরমাল ডেলিভারি নিয়ে  একা আমি অনিশ্চিত যাত্রায় যেতে পারবো না।

আমার ভাই, ননাস আর স্বামী আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। নার্সরা আমাকে তৈরি করে অপারেশনের জন্য। আমার বড় ভয় করে। আমার চোখ আমার মাকে খোঁজে। আমি তবু অমোঘ নিয়তি মেনে নেই। আমাকে যখন ও.টি.তে নিয়ে যায় আমার আর কারও সাথে দেখা করা হয় না। মৃত্যু হয়তো ঘাপটি মেরে আছে ওখানে…। কারও সাথে কি দেখা হবে আর?

(চলবে…)

শেয়ার করুন: