কাহানি টু: শিশুর ওপর যৌন নির্যাতন-বাস্তবতার ছবি

মাসকাওয়াথ আহসান: অধিকাংশ সময় আমাদের আধাগ্রাম্য-আধাশহুরে সমাজ বায়বীয় ও বিমূর্ত বিষয় নিয়ে চিন্তার কলতলা সরগরম করে রাখায়; সবচেয়ে জরুরি জীবন-ঘনিষ্ঠ বিষয়গুলো রয়ে যায় অনালোচিত। “কাহানি টু” চলচ্চিত্রটি দেখে আরেকবার ধাক্কা খেলাম; যে রকম ধাক্কা খেয়েছিলাম “মনসুন ওয়েডিং” চলচ্চিত্রটি দেখে। “কাহানি টু” চাইল্ড এবিউজ বা শিশুর ওপর যৌন নির্যাতন-বাস্তবতার ছবি।

একটি স্কুলে কর্মরত একজন তরুণী লক্ষ্য করে একটি ছয় বছরের কন্যা- শিশুর ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়ার ব্যাপারে অভিযোগ করছেন তার শিক্ষিকা। কন্যা শিশুটি কথা কম বলে। কিন্তু তার একটি বাক্যে বেরিয়ে আসে, রাতে কেউ তাকে ঘুমাতে দেয় না।

স্কুলে কর্মরত তরুণীর ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় বলে, এই কন্যাশিশুটিকে রাতে কে ঘুমাতে দেয় না, তা জানা দরকার। কারণ নিজের শৈশবেও এবিউজড বা যৌন-নিগ্রহের শিকার হবার অভিজ্ঞতা তরুণীর রয়েছে। কিন্তু শিশুটির ঘনিষ্ঠ নাহলে সত্য-উদঘাটন ও তাকে রক্ষা করা কঠিন। তাই তরুণীটি চেষ্টা করে শিশুটির সঙ্গে কথা-বার্তা বলতে।

ছয় বছর বয়েসী কন্যা শিশুটির পড়াশুনায় দুর্বলতার অজুহাতে স্কুলে কর্মরত তরুণীটি শিক্ষক পরিচয়ে তার বাড়ির পরিবেশটি জানতে সেখানে যায়। দেখে শিশুটির এক জাঁদরেল দাদী আর এক লোলচর্ম লাল্টু মার্কা চাচা রয়েছে। তার বাবা-মা দুর্ঘটনায় মারা গেছে। শিশুটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার ইচ্ছা থেকে স্কুলের ক্লাসের পরে একঘন্টা তাকে পড়ানোর প্রস্তাব দেয় তরুণীটি। দাদীটি এতে রাজি হয় না। অবশেষে বাড়িতে গিয়ে পড়ানোর একটা সমঝোতা হয়। এসময় লালসার লালামাখা চাচাটির আচার-আচরণ সন্দেহজনক ঠেকে তরুণীর কাছে।

এর মাঝে শিশুটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হওয়ায় কৌশলে তরুণীটি আবিষ্কার করে সেই তিক্ত সত্যটি; কন্যা-শিশুটি নিয়মিত বিকৃত চাচাটির যৌন নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। তরুণী তখন পুলিশে খবর দেয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার পুলিশ হচ্ছে কোন উপকারে না আসা ও ম্যানেজড হয়ে গিয়ে উলটো মারমুখি হয়ে যাওয়া উপমানব। তাদের কাছে সাহায্য পাওয়ার পরিবর্তে কন্যাশিশুটির দাদী-চাচার পালতো কুকুরের মতো পুলিশ স্কুলে কর্মরত তরুণীটিকে উল্টো চুরির দায়ে অভিযুক্ত করে।

আর স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাও যৌন-নিগ্রহের শিকার কন্যাশিশুর দাদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাসূত্রে যৌন নিগ্রহের অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়ে “দক্ষ দেখে পক্ষ নেয়”; শিশুটির জীবন বাঁচাতে সক্রিয় তরুণীটিকেই উলটো চাকরিচ্যুত করে। শিশুটির দাদী শিশুটিকে এইসব উটকো “ঝামেলা”-র জন্য দায়ী করে। শিশুটি তীব্র অভিমানে বাড়ির ছাদ থেকে ঝাঁপ দেয়। পঙ্গু হয়ে যায়। তাকে বাঁচানোর চেষ্টায় সক্রিয় তরুণীটি হাল ছাড়ে না। বিপদগ্রস্ত কন্যাশিশুটিকে নিয়ে পালিয়ে যায়; বদলে ফেলে নিজের নাম। সন্তান স্নেহে বড় করতে চেষ্টা করে; চিকিৎসা চালিয়ে যায় তাকে সুস্থ করে তুলতে। বিদেশে চিকিৎসা করতে নিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকে।

প্রতিশোধ স্পৃহায় কন্যাশিশুর বিকৃত চাচাটি তাকে অপহরণ করায় এক নারী পুলিশকে টাকা-পয়সা দিয়ে ভাড়া করে। অপহরণের ঘটনার পর দিশেহারা হয়ে তাকে খুঁজতে খুঁজতে গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে তাকে বাঁচাতে সক্রিয় সেই তরুণী কোমায় চলে যায়। সে কোমায় থাকার সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তা তরুণীর ডায়েরি পড়ে কন্যাশিশুটির ট্র্যাজেডির কথা জানতে পারে। কাকতালীয়ভাবে তরুণীটি পুলিশ কর্মকর্তার সাবেক স্ত্রী। সে অপেক্ষা করতে থাকে তরুণীটির কোমা থেকে জেগে ওঠার। কিন্তু এরই মাঝে পুলিশের যা কাজ; পুলিশ কর্মকর্তার বস বাগড়া দিয়ে বসে।

মাসকাওয়াথ আহসান, লেখক ও সাংবাদিক

কন্যাশিশুটিকে বাঁচানোর কাজটিকে জটিল করে দেয়। তরুণীটি কোমা থেকে জেগে আবারো মরিয়া হয়ে বিকৃত চাচা আর ভাড়া করা খুনে নারী পুলিশের হাত থেকে উদ্ধার করে শিশুটিকে। কিন্তু এদিকে পুলিশ তাকে শিশু অপহরণ ও পরিচয় বদলে ফেলার অভিযোগে গ্রেফতার করতে তৎপর হয়ে ওঠে। সাবেক স্বামী পুলিশ কর্মকর্তার সহযোগিতায় একটি দালানে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে তরুণীটি তার শিশুকন্যাসহ পুড়ে মারা গেছে এমন একটি দৃশ্যপট রচনা করে। এই কৃতিত্বে সেই পুলিশ কর্মকর্তার বস প্রোমশানও জোগাড় করে ফেলে। আর তরুণীটি আগুনে পোড়া বাড়িটির পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে তার কন্যাশিশুকে নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যায়। এই প্রথম মুক্তির আনন্দ চোখে পড়ে কন্যাশিশুটি আর তাকে নতুন জীবনদায়ী তরুণী ‘মা’র চোখে মুখে।

এতো চলচ্চিত্রের কাহিনী। সেখানে যৌন নিগ্রহের শিকার শিশুটির বেঁচে যাওয়ার স্বপ্নের বুননে আমরা দর্শকরা নৈরাশ্যের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসি। কিন্তু খরখরে জীবন বাস্তবতার পুত্র-কন্যা শিশুরা যৌন নিগ্রহের অন্ধকারে জীবন্মৃত অবস্থায় বেঁচে থাকে। প্রতিদিন লালসার লালামাখা লোলচর্ম পেডোফাইল বা শিশু-যৌন নিগ্রহকারীরা কেড়ে নেয় জুঁইফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুদের আনন্দময় শৈশব।

শেয়ার করুন: