ভাস্কর্য নয়, সরানো হোক মাজার

শারমিন জান্নাত ভুট্টো: বাংলাদেশ ধর্ম আর সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে কতটা নীরব থাকে তার প্রমাণ মেলে যখন চরমোনাই পীর নামে ভণ্ড এক ধর্মব্যবসায়ী সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে মূর্তি সরানোর কথা বলেন, অথচ কোর্ট প্রাঙ্গনে যখন অযথাই একটি মাজার জায়গা দখল করে রাখে, আর সেটিকে ঘিরে গাঁজা আর ধান্ধাবাজদের আখড়া গড়ে ওঠে, তখন সেটা নিয়ে কেউ কোন কথা বলে না।

এ মাজারকে ঘিরে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মানুষের মগজের ভেতরে কুসংস্কার আর ধান্দা চাষ করে কামিয়ে নিচ্ছে কাড়ি কাড়ি টাকা। শুধুমাত্র ব্যবসায়িক ফন্দি হাসিলের উদ্দেশ্যেই এ মাজারকে এখনও নিয়মিত লালন করা হচ্ছে। কোন ভক্তকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় কোর্ট প্রাঙ্গনে কার মাজার রয়েছে, তারাও ঠিক করে বলতে পারবে না। কারণ ক্ষণে ক্ষণে এ মাজারে সমাহিত ব্যক্তির নামও পরিবর্তিত হয়েছে, আর সেটা বিভিন্ন ইতিহাসবিদ ও গবেষণাকর্মীদের লেখাতেও ফুটে উঠেছে।

হাইকোর্ট মাজারে দেয়ালে দেয়ালে লেখা আছে এটি শাহ খাজা শরফ উদ্দিন চিশতি ওরফে বাবা ওলি বাংলার মাজার, যার ওফাত ৯৯৮ হিজরি। অথচ তা নিয়েও আছে বিশাল এক বিতর্ক। বলা হয়ে থাকে যে, এ মাজারে শায়িত আছেন ইসলাম খাঁ চিশতি। পরবর্তীতে জানা যায় ভিন্ন কথা ঐতিহাসিক শাহনাওয়াজ খানের রচিত ‘মাসির-উল-উমারা’ গ্রন্থে। সেখানে বলা হয়েছে যে, “ইসলাম খাঁ-র মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ফতেহপুর সিক্রি এবং দাফন করা হয়েছিল সেখানে। সম্রাট জাহাঙ্গীর সেই সমাধির ওপরে নির্মাণ করেন একটি স্মৃতিসৌধ।”

তবে ইতিহাসবিদ সৈয়দ তৈফুর জানিয়েছেন, শাহীবাগে (বর্তমান কোর্ট প্রাঙ্গন) সুবেদারের লাশ সাময়িকভাবে রাখা হলেও পরবর্তিতে তা নিয়ে যাওয়া হয় ফতেহপুর সিক্রিতে। আর সাময়িকভাবে ওই লাশ রাখার জায়গাটিকেই কবর বলে দাবি করা হয়। বিভিন্ন ইতিহাসবিদদের গবেষণায় যখন এটি স্পষ্টত প্রমাণ হয় যে, মাজারে আদৌতে কারো কবর নেই, তখন মাজার কমিটি আর ধর্ম ব্যবসায়ীরা বলা শুরু করে, কোর্ট প্রাঙ্গনে শরফুদ্দিন চিশতির কবর রয়েছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, কে এই শরফুদ্দিন চিশতি?

বলা হয়ে থাকে যে, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির মেজো ছেলে হলো শরফুদ্দিন চিশতি। অথচ এই নামে মঈনুদ্দিন চিশতির কোনো ছেলেই নেই। ওয়াকিয়া-এ-শাহ মইনুদ্দীন (পৃষ্ঠা ৫৩) এবং আহসান-উস-সিয়ার (পৃষ্ঠা ১৫৯) এর বিবরণ অনুসারে, মঈনুদ্দিন চিশতি দুটি বিয়ে করেন। প্রথম ঘরে তিনটি সন্তান, যথাক্রমে ফখরুদ্দীন, হিসামুদ্দীন এবং বিবি হাফিজা। আর দ্বিতীয় ঘরে একমাত্র সন্তান জিয়াউদ্দীন।

তাহলে এই শরফু্দ্দিন চিশতি কে কিংবা কী তার আসল পরিচয়? এ প্রশ্নের উত্তর বোধ করি মাজার কমিটিও এখন পর্যন্ত খুঁজে বের করতে পারেনি। আর এর উত্তর জানতে পারলে আমরাও উপকৃত হবো নি:সন্দেহে। জানিয়ে রাখা ভালো, ইতিহাসবিদদের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত, তথ্য আর বিবরণীতে এটিই বের হয়ে আসে যে, হাইকোর্টের মাজারটি আসলে শূন্য একটি মাজার। আর এর সাথে চন্দ্রিমা উদ্যানের তথাকথিত রাজনৈতিক নেতার মাজারটিরও বেশ মিল পাওয়া যায়।

এখন আসল প্রসঙ্গে আসি, কেনো এ মাজারগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে সরানো হয় না? যদিও এসব ভুয়া মাজার, তবুও এগুলোকে ঘিরে একটি সংঘবদ্ধ চক্র দিনে-দুপুরে ডাকাতি করে চলছে। দৈনিক হাজার হাজার টাকা তারা উপার্জন করছে অন্ধ বিশ্বাসীদের কাছ থেকে। যারা বিভিন্ন মানত ও উসিলা নিয়ে সেখানে ভীড় জমায়, আর তাদেরকে অন্ধের মতো পরিচালিত করে কিছু অসাধু ধর্ম ব্যবসায়ী। তারা দান-খয়রাত বাবদ টাকা আদায় করে সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে। আর তা দিয়ে গড়ে ওঠে অসামাজিক চক্র। মদ,গাঁজা কী পাওয়া যায় না এসব মাজার প্রাঙ্গনে!!!

শুধু তাই নয়, বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো পর্যন্ত এসব মাজারের পৃষ্ঠপোষকতা করে। আর এটা শুধু যে নেহায়েত নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে তা নতুন করে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন আমার প্রশ্ন হলো, যে হাইকোর্ট অন্যান্য স্থানে থাকা মাজারের বিষয়ে তাদের রায় দিলো সেখানে নিজেদের প্রাঙ্গনে, নাকের ডগায় একদল কুচক্রী সমানে ব্যবসা করে যাচ্ছে, অথচ তাদের কিছুই বলছে না!

সর্ষের ভেতর আসলেই ভূত থাকে। আর এ কারণেই বলতে চাই, মূর্তি না সরিয়ে, উচ্ছেদ করা হোক মাজার। বন্ধ হোক ধর্ম নিয়ে যত্তোসব ব্যবসা, আর জালিয়াতি।

শেয়ার করুন: