ইশরাত জাহান ঊর্মি: বহরপুরের সিনেমা হলের নাম ছিল “ললিতা”। আর বালিয়াকান্দির সিনেমা হল “চন্দনা”। বহরপুর হলো বালিয়াকান্দি থানা থেকে মাইল দুয়েক দূরত্বের একটা ইউনিয়ন। সেসময় মফ:স্বল আর ইউনিয়নে সিনেমা হল থাকতো। শীতকালে যাত্রা-টাত্রা হতো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্কুলের ছেলেমেয়েরা নাচতো,গাইতো। এখন সেসব আছে কীনা জানি না, তবে চন্দনা বা ললিতা নেই। কেন নেই সে অন্য গল্প। যা লিখতে বসেছি।
একবার ললিতা সিনেমা হলে মারমার কাটকাট একটা সিনেমা চললো। সিনেমার নাম বাংলার বধূ। কয়েক সপ্তাহ ধরে চললো, হাউজফুল। আমরাও-মানে কয়েক বান্ধবী মিলে সে সিনেমা দেখতে গেলাম। কার পরিচালনার সিনেমা মনে নাই, একটু ঘাঁটলেই পাওয়া যেতো, কিন্তু এইসব আবর্জনা জানতেই হবে এমন কোন কথা নেই।

সেটা ১৯৯২/৯৩ সালের কথা, আমরা ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি।
সিনেমাটার গল্পের মূল জিস্ট মনে আছে। বড়লোক-ভদ্রলোক আনোয়ার হোসেন ছেলে আলমগীরকে নিয়ে ব্যবসার কাজে ঢাকার বাইরে গেলে পথে একগ্রামে গাড়ি নষ্ট হওয়ায় বিরাট বিপদে পড়েন। ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত বাপ-ছেলে এক বাড়িতে গিয়ে পানি খেতে চান। তখন সুন্দরী-সুবেশী, গা ঢেকে শাড়ি পরা শাবানা সুশীতল জলের গ্লাস এগিয়ে দেন। পানি এবং দুপুরে সে বাড়িতেই “আজকালকার অসভ্য মেয়েদের মতো না” শাবানার রান্না খেয়ে ছেলের জন্য বউ পছন্দ করে ফেলেন আনোয়ার হোসেন।
বিবাহ সম্পন্ন হয়। অপেক্ষাকৃত গরীব ঘর থেকে বিয়ে করিয়ে আনা শাবানা সর্বগুণসম্পন্ন। সে শ্বশুর-শাশুড়ীর সেবা করে, রান্না করে, দেবর এর ক্লাসের পড়া দেখিয়ে দেয়, কারণ সে “বিএ” পাস, স্বামী সোহাগীও সে। তো, বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই শাশুড়ী “মা এবার বংশপ্রদীপ দেখতে চাই” বললে স্বামী-স্ত্রী দুজনই চিন্তায় পড়ে যান। কারণ তারা বাচ্চার জন্য চেষ্টা করছিলেন।
যাই হোক, আলমগীর বউকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে বেরসিক ডাক্তার দুজনকেই পরীক্ষা করে জানান যে, আলমগীরের বাবা হওয়ার ক্ষমতা নেই।
হলভর্তি দর্শকের মতো আমরাও বিস্মিত হই। ছেলেদের আবার ক্ষমতা-অক্ষমতা কী? বাচ্চা না হওয়া তো মেয়েদের দোষের ব্যাপার। অন্তত আমরা তাই জানতাম।
তো এই রিপোর্ট নিয়ে বাড়ি ফেরার পর, শাবানা পরিবারের সবার সামনে স্বামীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলেন যে, তিনি বন্ধ্যা এবং তার মা হওয়ার যোগ্যতা নেই। স্বামীকে সে কিছুতেই কারো সামনে “ছোট” হতে দেবে না। নিজের গায়ে সে “কলংক” নেয়।
এরপরের গল্প আমার অত মনে নেই, আবছা যতটুকু মনে পড়ে, শাবানা পরে প্রেগনেন্ট হয় কারণ ডাক্তারের রিপোর্ট ভুল ছিল। আর এদিকে যেহেতু আলমগীর বাবা হতে পারবে না বলে জানা গেছে, সেহেতু শাবানাকে শ্বশুরবাড়ির সবাই ‘চরিত্রহীনা’ বলে সাব্যস্ত করে, এতে আবার এক খলনায়কের ভূমিকা থাকে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
বন্ধ্যাত্ব নিয়ে লিখতে গিয়ে সিনেমাটার কথা মনে পড়লো। “বন্ধ্যাত্ব” এই একটা শব্দ কত-শত নারী পুরুষের জীবন পাল্টে দেয়। তবে পুরুষের জীবন অতটা পাল্টায় না যতটা পাল্টায় নারীর জীবন।
নারীজন্ম দায়’এর জন্ম। তাকে অদ্ভুত সব দায় নিতে হয়। সে বলতে পারবে না, আমি বিয়ে করবো না, সে বলতে পারবে না, বাচ্চা ভালো লাগে না, বাচ্চা-কাচ্চা চাই না, এমনকি সে কয়টা বাচ্চার মা হবে তাও ঠিক করে দেবে অন্যরা। আমি আমার জীবনেই আমার অনেক প্রিয় মানুষের কাছেও অনেকবার শুনেছি,
“মা হতে চাও না? তোমার জীবনই তো পূর্ণ হবে না!”
মাতৃত্বকে নারীর পূর্ণতা হিসেবে দেখা হয় এবং সেই “পূর্ণতা” তাকে বাধ্যতামূলক অর্জন করতে হয়, পুরুষ এর পূর্ণ হওয়ার কোন দায় নেই। মা হতে পারছে না বলে প্রবল প্রতাপশালী নারীকেও আমি শ্বশুরবাড়িতে মিউমিউ করতে দেখেছি।
বন্ধ্যাত্ব বা ইনফার্টিলিটি বায়োলজিক্যাল। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এটা সামাজিক। এই শব্দটা মাথায় এলেই শিক্ষিত-অশিক্ষিত, স্বচ্ছল-অস্বচ্ছল পরিবার নির্বিশেষে মলিন, বিব্রত, লজ্জিত, অপরাধী, নতমুখ যে চেহারাগুলো চোখে ভাসে সেগুলো নারীর মুখ, পুরুষের নয়।
ইনফার্টিলিটি দোষের না। সায়েন্স বলছে, নারী-পুরষ উভয়েরই এই সমস্যা হতে পারে। নারীর ফেলোপিয়ান টিউব, গর্ভাশয় কিংবা ডিম্বাশয়ের সমস্যায় বন্ধ্যাত্ব হয়। গর্ভধারণের সময়ে অতিরিক্ত ওষুধ সেবনের কারণেও গর্ভস্থ কন্যা তার পরিণত বয়সে গর্ভধারণে অক্ষম হতে পারে। পুরুষের বীর্যে শুক্রাণুর স্বল্পতার কারণে হতে পারে বন্ধ্যাত্ব। ১৫ শতাংশ নারী এ সমস্যায় ভোগেন। এ সমস্যার জন্য নারী ৫০ ভাগ এবং পুরুষ ৩৫ ভাগ দায়ী। চিকিৎসাবিজ্ঞান এর উন্নতির ফলে এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব।
কিন্তু সামাজিক সমস্যার সমাধান কে দেবে? বাচ্চা না হওয়া মানেই নারীর দোষ, এই চিন্তা থেকে আমাদের সমাজ কি বের হতে পেরেছে? গ্রামের সমাজের কথা বাদই দিলাম, শহুরে সমাজ? না, এখন হয়তো বন্ধ্যা নারীকে সামাজিক অনুষ্ঠানে না ডাকা, তাকে গঞ্জনা দেওয়া এসব কিছুটা কমেছে; কিন্তু মনের ভেতর যেসব চিন্তা? নারীকে দোষী দেখার প্রবণতা? এই সমাজ নারীকে বাচ্চা উৎপাদনের যন্ত্র ভাবা বন্ধ না করা পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান নেই। এখন পর্যন্ত বাচ্চা না হলেই কোনরকম পরীক্ষা ছাড়াই নারীর দিকে আঙুল তোলা হয়। পুরুষকে পরীক্ষা করার কথা কারোর মাথায় আসে না। এটা যতো না সচেতনতার অভাব, তার চেয়ে বেশি দায়ী নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি।
আমি এরকম একটা পরিবারকে চিনি যারা ছেলের বউকে তাড়িয়েছেন বাচ্চা হয় না বলে, ছেলেকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করিয়েছেন এবং এইবারও একই কেইস। অশিক্ষিত পরিবার না, তথাকথিত শিক্ষিত পরিবার।
বন্ধ্যাত্ব রোগ হতে পারে। রোগ তো লজ্জার কিছু নয়। রোগের কারণ নির্ণয় করে সমাধান করার পরিবর্তে আমাদের সমাজে শাবানার মতো স্বামীকে ছোট না করার ফর্মুলাও চলেছে। সিনেমার “পুরুষ” পরিচালকরা এইসব তাবিজ-কবচ মহৎ হতে চাওয়া নারীকে এবং সমাজকে খাইয়েছে।
আমার আশা যে, দিনে দিনে এসব বদলাবে। নারী, বন্ধ্যা নারী বা পুরুষ হিসেবে নয়, প্রতিটা মানুষের সম্মান এবং পূর্ণতা নিহিত তার মানুষ হয়ে ওঠার মধ্যেই। এইটা সবাই শিখুক, বুঝুক।