একপ্রকার মানসিক বিকৃতি এবং পুরুষের রসবোধ

তানিয়া পলি: ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে সতর্কতা নিয়ে কদিন আগে মডেল নায়লা নাঈমের বিতর্কিত সেই বিজ্ঞাপন আর অশ্লীল উপস্থাপনায় যৌন উস্কানিমুলক ভাষার ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক হইচই এর ব্যাপারটা বোধকরি সবারই মনে আছে

চারদিকে হইচইটা যখন তুঙ্গে, ঠিক সেসময় একদিন সকালে অফিসে ঢুকেই শুনতে পাই পাশের কজন কলিগ মিলে ওই বিজ্ঞাপন নিয়ে ব্যাপক হাসি-তামাশায় মত্ত। ওদের নিজেদের মধ্যেই ঠাট্টা, তামাশা করার ভঙ্গি আর বেশ জোর আওয়াজ, দুয়ে মিলে চরম অস্বস্তি হচ্ছিল। তবুও অস্বস্তিটাকে গিলে নিয়েই নিজের কাজে মনোযোগ দেই।

বেলা গড়িয়ে প্রায় ১২টা বাজে। তখন অব্দি ওদের ওই রসাত্মক আলোচনা ক্ষ্যান্ত হয়নি। কান দুটোকে যতই বলছিলাম প্লিজ সয়ে যা, ধৈর্য্যটাকে যতোই বলছিলাম, কিছুতেই বাঁধ ভাঙ্গিস না যেন, কিন্তু সকাল থেকে বয়ে বেড়ানো অসহ্য বিব্রতভাব চরম অস্বস্তিটা একপর্যায়ে বাঁধ ভেঙ্গে ফেটেই পড়লো

আস্তে করে দাঁড়িয়ে কন্ঠে চরম বিরক্তি ক্ষোভ নিয়ে দুজনকে নাম ধরেই বললাম, আচ্ছা ভাই যতদূর জানি আপনারা প্রত্যেকে বিবাহিত, আর এও জানি আপনাদের দুজনেরই মেয়ে বাচ্চা আছে। তাইলে একবার ভাবুন তো, আপনি রাস্তায় বেরিয়েছেন ভাবী আপনার মেয়েকে নিয়ে, আর তখন অন্য কোনো পুরুষ আপনার স্ত্রী বা মেয়ের দিকে ইংগিত করে নায়লা নাঈমের ডায়ালগ দিল এভাবেই…………………দেখবেন, ধরবেন, চেক করবেন………।”

বলুন তো, আপনার তখন কেমন লাগবে, খুব কি সুখকর লাগবে বিষয়টা? কিংবা এখন একবার ভেবে বলুন তো রসবোধে টইটুম্বুর এই আপনি সত্যিই কি এখনকার মতো এমন সুখবোধ অনুভব করবেন তখন? পারবেন কি? পারবেন না, জানি পারবেন না একদমই। কারণজাতে মাতাল তালে ঠিকবলে একটা কথা আছে না! আর সেজন্য আপনি পারবেন না

হঠাৎই ব্যাপক জোর আওয়াজে কথাগুলো বলছিলাম এবং খেয়াল করলাম মুহুর্তেই চারপাশটা একদম চুপ হয়ে গেল। যে দুজনকে বলছিলাম তারা আর টুঁ শব্দও করেননি। অন্য একজন একটু বাতাস দেয়ার প্রচেষ্টায় বলে উঠলো, বুঝলেন আপু, সবগুলা আনকালচারড

মেজাজটা এবার আরো একধাপ বিগড়ে গেল। একদম চুপ থাকেন, এটাকে মোটেই আনকালচারড বলে না, এটাকে রসবোধও বলে না, এটা হলো চরমভাবে এক প্রকার মানসিক বিকারগ্রস্ততা। যদি তাই না হতো, তবে এই বিতর্কিত বিজ্ঞাপন নিয়ে এভাবে অশ্লীলভাবে অফিসের কাজের পরিবেশ বিনষ্ট করে, এত বিশ্রী রসালোতায় মত্ত হতে পারতেন না আপনারা

আপনাদের ভাবা উচিৎ, আপনার পাশের ডেস্ক বসেই আপনার ফিমেল কলিগরাও কাজ করছেন। আর আপনার এই বিকৃত আচরণ, কুরুচিপূর্ণ রসবোধ তাঁদেরকে বিব্রত করছে কিনা, অস্বস্তিতে ফেলছে কিনা, তাও ভাবুন।
প্লিজ, অফিসে কাজের পরিবেশটা আর এভাবে নষ্ট করবেন না যেন

নিজের তিক্তকর এক অভিজ্ঞতায় এতোক্ষণ কথাগুলো বলছিলাম। আমার ধারণা এহেন তিক্ততার সম্মুখীন হননি, হয় না এমন কোন মেয়েই নেই। হোক তা অফিসে, পাবলিক প্লেসে কিংবা পারিবারিক পরিবেশেও

অফিসের মতই যেকোনো পাবলিক প্লেসে চলতে গিয়েও প্রতিনিয়ত পুরুষের এমন বিকৃত রসবোধের আচরণ, ইংগিতে বিব্রত হতে হয় ওই নারীকেই। এমনকি একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, পারিবারিক পরিবেশেও আত্মীয় কিংবা অনাত্মীয় পুরুষের অমন বিকৃত রসবোধে প্রায়শই অস্বস্তিতে পড়তে হয় ওই নারীকেই

আমরা এই নারীরাও এজন্য নিজেদেরকে দায়মুক্তি থেকে এড়াতে পারি না কিন্তু। কারণ হলো আমরা শুধু মুখ বুঝে সহ্য করতেই শিখে গেছি, এহেন চরম বিব্রততা কে হজম করতে আমরা বেশ পটু, অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকার শিল্পটা আমরা রপ্ত করে নিয়েছি বেশ সৌখিন কৌশলেই।পুরুষকে সবদিক থেকেই অসীম শক্তিধর ভাবতে পছন্দ করি এই আমরা নারীরা , আর তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটে চলছে।

তাইতো পুরুষের এহেন অন্যায়ের প্রতিবাদে আমরা কুন্ঠিত হই, ভেতরে চরম অশান্তি, অস্বস্তি নিয়েও আমরা চুপ করে হজমে অভ্যস্ত। কেননা নারী যখন প্রতিবাদী ভূমিকায় গর্জে ওঠে তখন তো সে আর নারী থাকে না। তাঁকে আখ্যায়িত করা হয় অভদ্র, অসভ্য, বেজায় মুখরা মেয়েমানুষ হিসেবে। আর এই আখ্যানে উপাখ্যিত করার অধিকার ও একচ্ছত্র অধিপতি যেন ওই পুরুষই

আর এসব তকমা থেকে বাঁচার জন্য, নিজেকে ভালো, ভদ্র,বিনয়ী অধিকতর কোমনীয় রূপে প্রতিষ্ঠার জন্য নারী প্রতিনিয়ত নিজেকে শুধু গুটিয়েই নেয়, নিচ্ছে। কিন্তু বলি কী, আর কতো?

ওহে ভোলাভালা, অবলা ভদ্র ভগ্নিটি, তোমাকেই বলছি শোনো। প্লিজ……… শোনো! তোমারই আত্মসম্মান রক্ষায় প্রয়োজনে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তুমি যদি কিছুটা প্রতিবাদী হও, তুমি কিন্তু মোটেই মন্দ হয়ে যাবে না

আর যে পুরুষ তোমাকে অভদ্র, মন্দ বলে আখ্যায়িত করবে, আরে সে তো কোনো সুস্থ মস্তিস্কের পুরুষই নয়, সে তো টইটুম্বুর কুরুচিপূর্ণ রসবোধে আসক্ত বিকৃত মানসিকতার অসুস্থ পুরুষ। তাঁকে তোমার কীসের এতো ভয়, শুনি??

পরিশেষে, ওহে পুরুষ ভাই, বন্ধু, সহকর্মী আপনাকেই বলছি, দয়া করে সংযত হোন। আপনার রসবোধকে মার্জিত মার্জিনের বাইরে নিবেন না প্লিজ। নিজের রসবোধের বিকৃততায় অফিসে কোন সহকর্মী কিংবা অন্য যেকোন জায়গায় কোন নারীকে বিব্রত করা থেকে বিরত হোন এখন থেকেই।

কেন এভাবে ভাবছেন না একবার, যে নারীকে সম্মান দিতে এই উদাত্তচিত্তে আপনাকে আহ্বান জানাচ্ছি, সে নারী তো আপনারই সহকর্মী, বোন বা মেয়ে, আপনারই মা কিংবা স্ত্রী। কেন ভাবছেন না এভাবে? কেনই বা ভাববেন না, বলুন?

শেয়ার করুন: