লুকানো ডায়েরি থেকে -১০

চেনা অপরিচিতা: বিয়ের পর প্রথম বেড়াতে গেলাম খালার বাসায়। ওখানে অনেকদিন পর কাছের মানুষের আদর যত্ন পেলাম। অন্তত অপমানের ভয় ছিল না। আমার খালা আমার মায়ের সাথে যোগাযোগ করলেন। কিন্তু আমার মা খুব রেগে ছিলেন। খালা বার বার অনুরোধ  করা সত্ত্বেও কিছুতেই আসবেন না আমাকে দেখতে বা গ্রহণ করতে, কড়াভাবে জানিয়ে দিলেন।

কিন্তু আম্মা আসলো। দুপুরের একটু পর কেউ বেল বাজাল। আমি ফুচকি দিয়ে দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি। কালো হয়ে শুকিয়ে গেছে। চিনলাম পরনের শাড়ী দেখে। দেখে ভয়ে গিয়ে রুমের ভেতর লুকালাম। খালা পরে নিয়ে গেলেন মায়ের কাছে। আকুল হয়ে কাঁদলাম মায়ের কোলে মাথা রেখে।

আম্মা আমাকে বাড়ি নিয়ে গেলেন। অনিশ্চয়তা আর ভয় বুকে নিয়ে গেলাম। সারা পথ মা নানা রকম খাবার সাধলেন। অনেক দিন পর বাড়ি ফিরলাম। মাধবীলতার দখিনা বারান্দা, লাইব্রেরি, শোবার ঘর। কিন্তু একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে।

আমি জানি না আমার নতুন পরিচয় গ্রহণীয় হবে কিনা! আমার স্বামীও যে আমার যাওয়াটায় ভয় পাচ্ছে, তা তার সাথে কথা বলে বুঝে গেলাম। সে রাতে মায়ের সাথে ঘুমালাম। সকালে ঘুম ভাঙলো ঠেশ মারা অশ্লীল কটু কথায়। কথাগুলো বাবা-মা বলছে, এবং কথাগুলো একজন সন্তানের পক্ষে লজ্জাজনক। আমি কাঁথার নিচে মুখ ঢেকে রাখলাম। বুঝলাম, আমার বিয়ে তাদের কাছে এখনও গ্রহণীয় হয়নি।

সকাল ১০/১১ টার দিকে যখন আমার নিজের সংসারে ফেরার কথা বললাম, আমার মায়ের চেহারা থেকে রক্ত সরে গেল। তিনি জানালেন, এটা আমার বাবা শুনলে কষ্ট পাবে। আমি বললাম, আমি আবার আসবো, বাসায় ছুটা বুয়া আসে, আমার যেতে হবে। আসলে আমার দারুণ অস্বস্তি হচ্ছিল। আমার বাবা-মা আমার বিয়ে স্বীকার করবেন না। বাড়ির ভাড়াটে এলে আমাকে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছিল। আম্মা হুজুরের সাথে নিচু গলায় কথা বলছিল। আমার স্বামীও ইনসিকিউরিটিতে ভুগছিল। সাথে আমিও। আমাকে যদি আটকে রেখে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে!

কী  অদ্ভুত! পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়কে ভয় পেতে হচ্ছিল। এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে!

আমার যাওয়ার কথা শুনে আমার বাবা মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার মতো ভাব করলেন। আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হেসে বললাম, আবার আসবো, আজ বাসায় কাজ আছে।

কিন্তু আমার বাবা কাজের লোককে সামনে থেকে বিদায় করে অনেক আজেবাজে কথা বললেন।

যাই হোক, আমি চলে এলাম। সারাপথ চোখ থেকে পানি ঝরল। আমি পানি মুছতে মুছতে আমার বাসায় এলাম। আর কিছু না হোক, পালিয়ে স্বস্তি পেলাম।

এক সপ্তাহ সেই স্মৃতি আমাকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে রাখল। আমার বাবা-মা চেষ্টা করতে লাগলেন আমার স্বামীর চাকরিটি যাতে চলে যায় তার ব্যবস্থা করতে। তখন অভাবের তাড়নায় আমি ফিরে আসবো সেই আশায়। আমার শ্বশুরবাড়ির থানায় আমার স্বামীর বিরুদ্ধে হুমকি-ধামকি, আর হুজুরের তদবির তো ছিলই। এসব টানাপোড়েনে আমার স্বামী ঘূণাক্ষরেও আমাকে কোন কটু কথা শোনায়নি, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ।   

এসময়টাতে অনেক জায়গায় চাকরির চেষ্টা করেছি। কেউ কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়েও রক্ষা করতে পারেনি। উলটো কথা শুনিয়েছে।

বছর দুই পরে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি হয়। চাকরি স্থল ভিন্ন শহর। প্রচণ্ড দ্বিধা আর অস্বস্তি কাজ করছিল। আমি তো এমনিতেই একলা হয়ে গিয়েছিলাম সবার থেকে। আত্মীয় স্বজন (বাবার দিকের) আমাকে কার্যত ত্যাগ করেছিল।

একবার এক কাজিন তার শ্বশুরবাড়িতে আমাদের দাওয়াত দিলেন। আমি আমার স্বামীকে নিয়ে গেলাম। বিয়ের পর কেউ দাওয়াত দিল, তাও আমার দিকের। খুশি মনে নতুন জামাই নিয়ে গেলাম। আমার ফুপুরা কেউ কথা বললেন না। আমার ভাইয়ের সাথে কথা বললেন, কিন্তু আমাকে কেন দাওয়াত দেওয়া হয়েছে এটা নিয়ে পরে অনেক সমস্যা হয়েছিল। আমার কাজিনের স্ত্রী আরেকবার দাওয়াতের কথা বললেও আর ডাকার সাহস পাননি।

সে যাই হোক। আমি একটু হোমসিক আর পরিবার ঘেঁষা মেয়ে। এমনিতেই অনেকটা একঘরে হয়ে আছি। স্বামী ছাড়া আমার পৃথিবীতে তখন কেউ নেই। কীভাবে একলা একটা শহরে থাকবো, চাকরিটা ভাল। কিন্তু আমি জয়েন করবো কী করবো না, বা করার কথা চিন্তা করে কাঁদতাম।

তখন আমার স্বামী আমাকে বুঝাতো, শান্ত করতো। বাংলাদেশী স্বামীরা সাধারণত যেটা হতে দেয় না। আমার স্বামী আমাকে চাকরি করতে সাপোর্ট করতো। তাও ভিন্ন শহরে।

চাকরিতে জয়েন করার আগে বাবা-মায়ের কাছে গেলাম মিষ্টি নিয়ে। তারা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দেখলেন। উচ্ছ্বসিত হলেন না। বরং ছোট পদ দেখে সন্তুষ্ট নন বুঝলাম। আমি সেভাবে ভালো কোন রিঅ্যাকশন আশাও করিনি। কিন্তু একটু কিছু ভাল শুনতে হয়তো অবচেতন মন চেয়েছিল।

আমি কাঁদতে কাঁদতে অচেনা শহরে যাই, জীবিকার তাগিদে। ছুটিছাটায় আমার স্বামী আসে, আমিও যাই। বাকী সময় আমি খুব একা বোধ করি। আমি কাজে ডুবে যাই। আমি রোবট হয়ে যাই। তবু মাঝ রাতে চোখ ভেঙ্গে জল নামে। দুঃস্বপ্ন দেখলে পাশে কেউ থাকে না যাকে আঁকড়ে ধরা যায়।  ছুটির দিনে ভয়ে ভয়ে কখনও ফোন করি মায়ের কাছে। তারপর পৃথিবীর সব কষ্ট, অপমান, গ্লানি আমার বুকে চেপে বসে, আমি কাঁদি আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে। আমি অপ্রকৃতস্থ হয়ে যাই।

আমার শরীর রোবট হতে হতে অদ্ভুত আচরণ করতে থাকে। ভীষণ ক্ষুধা লাগে বিকেল বেলায়। আবার খেতেও ইচ্ছে করে না। বাসায় ফেরার পথে ফুচকা খাই, চাইনিজ কিনি, ফাস্টফুড গপগপ করে গিলি। তারপর একটা সূক্ষ্ম সন্দেহ হয়।  দিবাগত এক রাতে যেদিন স্বামী আমার কাজের শহরে, আমার পাশে, সাহস করে জেনে নেই। বিস্ময়, আনন্দ আর এক চিলতে ভয় ছুঁয়ে যায়- হ্যাঁ, আমি মা হচ্ছি।   

(চলবে…)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.