রাবেয়া জাহান আভা: কোকিল আর দশটা পাখির কলতানে যখন শুরু হয় আমার সকাল, তখন ভাবতে ভালোবাসি আমি দেশেই আছি। থাইল্যান্ডে এসে আমার প্রথম প্রথম খুব মনে হতো, উন্নত বাংলাদেশ এটি। ভাষা আর উন্নত সুযোগ সুবিধার পার্থক্য থাকলেও যখন খাদ্যের প্রতিটি উপকরণই সহজে পেতাম, বা একটু বেশিই পেতাম, তখন অন্য দেশে আছি মনেই হতো না। ওরা অনেকটা কাঁচা খেতে পছন্দ করে, আর আমরা তা যত্ন করে রান্না করে খাই-খাদ্যাভ্যাসে এই পরিবর্তন ছাড়া খুব বেশি পরিবর্তন নেই। তবে হ্যাঁ, জীবনাচরণ আর দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য তো আছেই। আর এখানেই ফারাকটা আমি টের পাই তীব্রভাবে।
কয়েকদিন আগে দেখলাম, ফেসবুকে কেউ একজন বলেছেন যারা দেশের বাইরে থাকেন, তারাই দেশের সমালোচনা করে বেশি। আমি তার কথাটির সাথে পুরোপুরি একমত। কারণ দূর থেকেই বোঝা যায় দেশের প্রতিটি অবস্থা, যেমন বোঝা যায় মাকে। মা কতোখানি ভালবাসেন একজন সন্তানকে, সেটা উপলব্ধিরও সুযোগ এটি। তাই দূর থেকে যখন মার ভালোবাসার অভাব অনুভব করি, তখন একইসাথে বুঝতে চাই কতোখানি ভালোবাসা আর নিরাপদে ছিলাম তার বুকে। চিন্তা করতে ইচ্ছে করে মা ভালো আছেন। কিন্তু ওই দেশটাতেই যখন দেখি রাজ্যের অসঙ্গতি, তখনই মনটা খারাপ হয়ে যায়। আমি আমার দেশকে ছোট করতে চাই না কখনোই। দেশকে সবচেয়ে উপরে দেখতে চাই বলেই এই কষ্টটা পাই।
এখানে আসার পর প্রথম যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে তা হলো নিরাপত্তা। একজন মেয়ে হিসেবে সম্পূর্ণ নিরাপদ আমি। রাস্তায় হাঁটলে কেউ আমার দিকে খারাপ দৃষ্টি নিয়ে তাকাবে না, আমার ওড়না, ব্যাগ ধরে কেউ টানবে না জেনেই নিরাপদবোধ করি। অনেক রাতে যখন আমি একা কিংবা পরিবারসহ ঘরে ফিরি, তখন আমার ভয় করে না কেউ আমাদের বুকে ছুরি ধরে সব কেড়ে নিতে জীবনটাই নিয়ে যাবে। যে ঘরটা আমি মোটামুটি খোলা রেখেই বাইরে যাই, সেখানে তালা ভেঙ্গে সব নিয়ে যাবে কেউ, এমন আশঙ্কাও থাকে না মনে। যখন দেখি শত শত সাইকেল বাইরে পড়ে আছে, বা ভুলক্রমে কেউ কোন জিনিস বাইরে ফেলে গেছে, তখন নিজের ভেবে সেটি তুলে নেয়ার অভ্যাস নেই কারও। বাচ্চারা যখন বাইরে খেলে, তখনও নিশ্চিন্তে থাকি আমরা।
আমাদের দেশে রাজা কেন, নিজের বাবা মরে গেলেও মানুষের মধ্যে এতো শোক দেখিনি, যতোটা দেখেছি এদের রাজার মৃত্যুতে। যেখানে আমাদের শোক এক সপ্তাহও পার হয় না, সেখানে এরা শোক পালন করেছে মাসব্যাপী। এটা লোক দেখানো নয়, বরং এটি ছিলো একজন রাজা তথা বাবার প্রতি এদের সত্যিকারের শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা। এরা রাজাকে ‘বাবা’ বলেই সম্বোধন করে আর বিশ্বাসও করে ‘বাবা’ ভেবে। অথচ আমরা বাবাকে বুড়া ভেবে তার মৃত্যুতে শোক করি হিসেব করে, নির্দ্বিধায় পাঠাতে পারি বৃদ্ধাশ্রমে।
চিকিৎসার নামে ওষুধ আর টেস্ট-ফেস্টের বাহুল্য নেই এখানকার ডাক্তারদের। একবার তো পাশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে জ্বর, সর্দির চিকিৎসা নিতে গিয়ে একটু অবাকই হই। খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি ডাক্তার দেখাতে। নিয়ম মেনে জেনারেল ডাক্তার দেখালেও ওদের কাছে বিদেশি বলে যে ছাড়টুকু পেয়েছিলাম, তাতে মন্দ লাগেনি। তবে ওষুধ নেয়ার সময় যখন অপেক্ষা করছিলাম দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে, তখন পাশ থেকে একজন দেখিয়ে দিলেন অপেক্ষমানদের জন্য রাখা নির্দিষ্ট জায়গা। সিটে বসতে মনটাই ভালো হয়ে গেল।
কারণ সামনে একটা ছোট্ট স্টেজ মতো জায়গায় বসে কয়েকজন মধ্যবয়স্ক মানুষ বাজাচ্ছেন নাম না জানা সব বাদ্যযন্ত্র। সুরের মূর্ছনায় ভুলিয়ে দেয় চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের শরীর, মনের ব্যথা, বেদনাকে। ইচ্ছেমাফিক যারা দান করেন দানবাক্সে, সে টাকা চলে যায় হাসপাতালের ফান্ডে।
আমাদের দেশে গানবাজনার কথা বাদই দিলাম, ছোট জ্বরজারির জন্য ডাক্তার যে পথ্য দেন তাতে ভয়ে নিজের ভেতরেই বেদনা সংগীত বাজতে থাকে। হয় টাকার শ্রাদ্ধ, সাথে জীবনের।
নারী, বৃদ্ধা কিংবা শিশু বলে এদের জন্য আলাদা করে কোনো জায়গা বরাদ্দ থাকে না কোন যানবাহনে। তবে এরা যথেষ্ট নমনীয় এবং বিনয়ী বলেই বাসে উঠলে নির্দ্বিধায় ছেড়ে দেয় নিজস্ব আসন। দেশ থেকে এসে প্রথম প্রথম আমার একটু খটকা লাগতো বাসে উঠে। যে আমি গরম কালে বাসচালক, সহকারী বা যাত্রীদের মধ্যে তুমুল বাকবিতণ্ডা আর হাতাহাতি দেখে অভ্যস্ত, সেখানে তার চেয়ে তিনগুণ গরমে না জানি কীইনা দেখতে হবে। তবে তার কিছুই ঘটতো না।
আমার বাসায় যে হোম সহকারিরা সপ্তাহের একটি দিন পরিচ্ছন্নতার কাজে আসে, তাদের মধ্যে আছেন একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। এদের মধ্যে এই শ্রেণীবৈষম্য নেই বলেই এরা কী সুন্দর মিলেমিশে কাজ করে। আলাদা করে ভাবে না তাকে, ভাবে মানুষ হিসেবে। এই বোধ কি আছে আমাদের মধ্যে? আমরা মানুষ তো ভাবিই না, বরং তার জন্য একটা সুন্দর(!) নাম বরাদ্দ করে তাকে ভাবতে পছন্দ করি আলাদা মানুষ হিসেবে, স্থান, কর্ম দিতে চাই না সমাজে। অথচ এই মানুষটিই কাজ করে সবচেয়ে যত্ন করে, বিশ্বস্ততার সাথে।
শিক্ষা ব্যবস্থার কথাতো আগেই বলেছি। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা, যা কিনা একটা শিশুর পরিপূর্ণ মানসিক ও সামাজিক বিকাশে সিঁড়ি হিসেবে কাজ করে তা অতুলনীয় এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থায়। আমার ছেলের এক ক্লাসমেটের মায়ের সাথে কথা হলো সেদিন। উনি চাকরি ছেড়েছেন বাচ্চাকে সময় দিতে। তবে ইচ্ছে করলেই নাকি আবার চাকরি পেতে পারেন, তবে সেটা তার বয়স অনুযায়ী। অর্থাৎ যার যা বয়স সে হিসেবেই তিনি পাবেন নির্দ্দিষ্ট চাকরি। কাজেই কর্মসংস্থানের বিষয়টিও সুনিশ্চিত তাদের জন্য।
কম জনসংখ্যা আর সম্পদের আধিক্যের দেশটিতে যাতায়াতসহ সুযোগ-সুবিধার হারও বেশি। সম্পদের চেয়ে মানুষ আমাদের দেশে বেশি হলেও সততা, মানবিকতা, নৈতিক মূল্যবোধের বড় অভাব। বরং তার চেয়ে বেশি হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, অন্যের অমঙ্গল কামনা, মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্য না দেয়া, বিরোধ, নিরাপত্তাহীনতা সবকিছু এতো তীব্র যে দেশে ফিরলে আবার এসবের মুখোমুখি হতে হবে, ভাবতেই মনটা বিষন্ন হয়ে ওঠে।
আসছে নতুন বছর। প্রতিটি নতুন বছরই আমাদের কাছে নতুনরুপে আবির্ভূত হবে-এ প্রত্যাশা তো করতেই পারি। অধিক জনসংখ্যা আর কম সম্পদের দেশে আমি, আমরা তো স্বপ্ন দেখতেই পারি একটা নতুন বাংলাদেশের, যে দেশে আর কিছু থাক আর নাই থাক অন্তত মানুষ হিসেবে আমি মূল্যায়িত হবো, পারবো নিরাপত্তাবোধ নিয়ে একটু শান্তিতে ঘুমাতে, প্রতিটি সকাল হবে সুন্দর আর আনন্দময়।
পত্রিকার পাতা বা টিভিতে চোখ রাখলেই যেন আর শুনতে না হয় কোনো অশুভ সংবাদ, যেন দেখতে না হয় কোনো বিভৎস ছবি। এরকম একটা দেশের ছবি দেখতে চাওয়া কি খুব বড় চাওয়া?