“ওটা স্বাধীনতা নয়, ওটা দেশভাগ!”

লুতফুন নাহার লতা: কাজের শেষে আজ ঘরে এসে তারা টিভিতে দেখি ‘ভাল আছি ভাল থেকো’ অনুষ্ঠান চলছে। সময় পেলে আমি এটা দেখি। আমার ভালো লাগে।

আজ এই অনুষ্ঠানে গেস্ট হিসেবে এসেছেন নাট্যজগতের দিকপাল বিভাস চক্রবর্তী। বাংলা নাটকে তাঁর অনেক অবদান। অসাধারণ সব নাটকের জনক তিনি। জীবন ও রাজনীতি তার নাটকের মূল প্রতিপাদ্য। ১৯৭৪ এ বাংলাদেশে এসেছিলেন তাঁর অনন্য সাধারণ নাটক ‘চাক ভাঙ্গা মধু’ ও ‘রাজ রক্ত’ নিয়ে। আরো পরে ১৯৯০ এ এসেছিলেন ‘মাধব মালঞ্চি কইন্যা’ নিয়ে। তখন আমার সুযোগ হয়েছিল সামনে বসে তাঁর নাটক দেখার। কী যে মুগ্ধ হয়েছিলাম সেই নাটকের অসাধারণ উপস্থাপনা দেখে।

২০০০ সালের দিকে এসেছিলেন নিউইয়র্ক শহরে, তখন আবার দেখা, সে সময় তাঁর সাথে নিউইয়র্কের নাট্যকর্মীদেরসহ আমারও বেশ একটা সুযোগ হয়েছিল নাটক নিয়ে তার ভাবনা, তার গবেষণা ও সৃষ্টি নিয়ে কথা বলার।
আজ ‘তারা’ টিভিতে তিনি একান্ত গল্পে বললেন তাঁর দেশ ছাড়বার সমস্ত জীবনজুড়ে দুঃখ, বেদনা, ক্ষোভের কথা। সিলেট শহরে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বাবা ছিলেন গান্ধীবাদী স্বদেশী। একাধারে নাটক গান বাজনা, কবিতা, লেখালেখি এই সবের ভেতরেই কেটেছে তাঁর শৈশব। বেড়ে উঠেছেন সিলেটের সবুজ ছায়ায় আর দেশের মায়ায়।

তারপরে এলো দেশভাগের নিদারুণ দিন! ১৯৪৭ এ দেশ ভাগ হল! হৃৎপিণ্ড ভাগ হলো। তারপর সেই কৈশোরেই দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়া। নানান জায়গায় ঘুরে অবশেষে কলকাতায় স্থায়ী হওয়া। এই সব নিয়ে আজ কথা বলছিলেন তিনি। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়াকে তিনি রুদ্ধশ্বাস বেদনায় বলেন, ‘ওটা স্বাধীনতা নয়, ওটা দেশভাগ!’ দেশ ভাগ! দেশ ত্যাগ! বুকের ভেতর আজও তার কষ্টের দগদগে ঘা! বার বার বলছিলেন, ‘আমি আজও সেই সিলেটের জীবনকেই ধরে আছি, কেবল নানা পর্যায়ে তার নানান বিবর্তন ঘটেছে।’

—- আজ আমার এই লেখার পিছনেও ওই দেশ! নাট্যগুরুজন বিভাস চক্রবর্তীর কথা আমার প্রাণে বেজেছে। বেজেছে বড় করুণ সুরে। আজ আবারও বাংলাদেশে মৌলবাদী দল জামাত-শিবির-বিএনপি পুড়িয়ে জ্বালিয়ে শেকড়ে সমূলে দেশত্যাগে বাধ্য করছে এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে।

শুধু তাই নয় ১৯৭১ এর মতো স্বাধীনতার সপক্ষের প্রগতিশীল মানুষদেরও ঢালাওভাবে জবাই করে পুড়িয়ে, কুপিয়ে বিনাশ করছে।

দেশ ছাড়ার হৃৎপিণ্ড ছেঁড়া বেদনা তো বেজেছিল আমার বুকেও! আমাকেও ছাড়তে হয়েছিল আমার শহর, আমার ঢাকা , আমার খুলনা, আমার কৃষ্ণচূড়ায় রাঙা ক্রিসেন্ট লেকের ধার, শীতের শিউলি, নলেন গুড়ের সন্দেশ! আমার টেলিভিশন, রেডিও , আমার মায়ের টলমল চোখের জল! কোথাও ফেলে দেয়া কাগজের টুকরোতে লিখেওছিলাম -‘ জীবন বৃক্ষ হতে সুসময় উপড়ে নিলে প্রভু, শেকড়ে সমূলে ধ্বংসের স্রোতে ভাসালে আমারে।’

এই যে রাজনীতির বলী হয়ে, ধর্মের বলী হয়ে কী নির্মম গগনবিদারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভিটেমাটি, গাছপালা, খুকুর দোলনা, খোকার কাঠের ঘোড়া, মাটির ভাড়ে ঝোলাগুড় আর কুলের আচার, চালে গুঁজে রাখা কুলুঙ্গিতে মদা সুপুরি, পানের বরজ, পুকুর পার হলে শটিবন, ওপারে আদিগন্ত বিস্তৃত সর্ষে ক্ষেত, রান্নাঘরের পিছনে বাতাবি লেবুভরা গাছ, বাগান ভরা মধুর মতো মিষ্টি আম, কুয়োতলায় জলের ধারে কী উচ্ছাসে ফুটে ওঠা সবুজ পিপল শাক, উঠোনে চালগুড়ির আলপনা, ঘরের মাচানে তোলা শুকনো নারকেল, গোয়ালে মায়াভরা চোখে গরুগুলো, পূজোর ঘরের প্রতিমা সব ফেলে, স-ব ফেলে মানুষ চলে যেতে বাধ্য হয়! তার চেয়ে বুক পেতে বুলেট নেয়াও বোধ করি সহজ।

১৯৭১ আমাদের রক্তের বিনিময়ে এই দেশ
১৯৭১ এ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে দেশ, যে দেশে একটি অভূতপূর্ব সংবিধান আমরা পেয়েছিলাম, সেখানে তো বাংলার আদিবাসী থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ,মুসলমান সবার সমান অধিকার নিয়ে থাকবার কথা!

তবে কেনো আমার দেশ থেকে সংখ্যালঘু হবার অপরাধে দেশ ছাড়তে হবে আমাকে! দেশ, সরকার আমাদেরকে নিরাপত্তা দেবে না! রাষ্ট্র কেন আমাদেরকে আগলে রাখবে না!

আসলে কিছুই বদলায়নি, শুধু সময়ের সাথে সাথে বদল হয়েছে বিতাড়ন পদ্ধতি, আর সব রয়ে গেছে সমান। আজ যদি আমরা ফিরে তাকাই নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জ, রামু, দিনাজপুর, সিলেট, খুলনা, যশোর, পাবনা, রাজশাহী, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া তথা সারা বাংলাদেশের আনাচে কানাচে, দেখি একই নির্মমতার স্বাক্ষর। ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়েছে আজ, তাই একজন সাধারণ জলোদাস রসরাজকে ভিক্টিম বানানো হয়েছে ডিজিটালি। কিন্তু এখানেও সমাজের সেই খাদক শ্রেণী ধর্মের নামে বিতাড়ন করেছে অসংখ্য পরিবারকে। একটি স্বাধীন দেশের জন্যে এর চেয়ে হাস্যকর, এর চেয়ে করুণার আর কী হতে পারে!

১৯৪২ থেকে শুরু হয়েছিল যে বিভেদের রাজনীতি, আজও নানা ভাবে, নানা রুপে সেই একই অন্যায় অত্যাচারের চেহারাই দেখি। হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ভীতি প্রদর্শন করে, কী হিন্দু সম্প্রদায়, আর কী প্রগতিশীল উদারপন্থি যুক্তিবাদী মুসলমান সংখ্যালঘু, কাউকেই বাদ দেয়া হয়নি। তাদেরকে নাস্তিক, নাস্তিক্যবাদী, কাফের ইত্যাদি সুবিধাজনক নাম দিয়ে নির্বিচারে নির্মূল করার উৎসব চলছে সারাদেশ জুড়ে।

ঠিক যেমনটি আমরা দেখেছিলাম ১৯৭১ এ সারাদেশ থেকে খুঁজে খুঁজে বের করে নেয়া হয়েছিল মুক্তমনা প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদেরকে। সে তাঁরা হিন্দুই হোক, আর মুসলিমই হোক। ঠিক তখনকার মতোই বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনায় যারা আছেন তাদের কাছে ক্ষমতায় টিকে থাকাই এই মূহুর্তে বড় বিবেচ্য বলে মনে হচ্ছে, ফলে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে মৌলবাদের নির্মম আঘাত নেমে এলেও   তাদেরকে বিন্দুমাত্র বিচলিত মনে হচ্ছে না। এ সকল অপরাধের প্রত্যক্ষ সঙ্গী তারা না হলেও মৌলবাদের কাছে তাদের এক নতি স্বীকারের প্রতিমূর্তিই আমরা দেখতে পাই।     

যে সত্যকে তিরিশ লক্ষ মানুষের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে অর্জন করা হয়েছিল, সেই সত্য হলো এই মাটির অন্য নাম ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’। এই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কোথাও যেনো এই নির্মম নিষ্ঠুরতা আর সংঘটিত না হয়! এই দেশ আমাদের সবার! সকল প্রতিকূলতায় আমরা সবাই যেন একসাথে থাকি! কাউকে যেনো রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য জীবন দিতে না হয়, আর কাউকে যেনো নিজের দেশ ছেড়ে যেতে না হয় কোনোদিন কোনোখানে।  

সৈয়দ শামসুল হকের নূরলদিন এর মতো বাংলার মুক্তিকামী প্রতিটি মানুষের অন্তরের এই-ই প্রার্থনা।——
‘দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ
ঘরে ঘরে মোর ভাই আছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ
ঘরে ঘরে মোর ভগ্নী আছে
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ
পুত্র আছে, আছে
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ
কন্যা আছে, আছে।
সুখে দুঃখে অন্ন পানে সকলেই এক সাথে আছে।
সোনার বাংলার সোনা বাংলাদেশে আছে।’

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.