জেসিকা মিথিলা: তালাক শব্দটা শুধুই আমাদের জন্য জন্ম হয়েছে, এটা পুরুষের কী? কী সহজ সাবলীল নিষ্ঠুর এক শব্দ, এর পিছের কান্না এই সমাজের কি চোখে পড়ে? বিয়ের পর স্বামীর হাত যখন মধ্যরাতে শরীরে আনাচে-কানাচে নিরবে উঁকিঝুঁকি মারে, কে জানে সেই মানুষটাই কোনো একদিন এই তালাক নাম ঠুকে দিবে পেরেক দিয়ে এই শরীরে… শব্দের বহুল ব্যবহার..
প্রথমত: বাঙালি পরিবার থেকে, এই মেয়েকে শুনতে হবে, মেয়েদের বিয়ে জীবনে একবার হয়.. তালাক তো দিয়ে দিলো, এখন?

এক স্বামীরই ভাত খাওয়া গেল না! কে নিবে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ…
দ্বিতীয়ত: প্রতিবেশী থেকে- আহারে, কতো ভালো ছেলেটা, দেখেশুনে এই মেয়েই জুটলো”? ভালো, জুটলো তো জুটলো, মুখরা, অপয়া মেয়েটা, তালাক দিসে, এখন দেখে-বুঝে একটা সুন্দর ছোটো-খাটো মেয়ে এনে সুখে থাক, বেয়াদবি করলে তালাক দিবে না তো কী করবে, স্বামীর ঘর করা এতো সোজা? *( যারা এ বিষয় নিয়ে কথা বলছে তারা কিন্তু “নারী”)
তৃতীয়ত: তালাক দেয়া স্বামী- বাবা-মা এর কথা ভাবতে তো হবে, পাত্রী দেখছে, ব্যস্ত..
চতুর্থত: তার পরিবার: মেয়েটার চরিত্র ভালো না, তালাক না দিলে আমার ছেলের পক্ষে এ মেয়ে নিয়ে সংসার করা যায়?
আমি কল্পকাহিনী বলিনি, তালাকটা আমি বা সে দেয়নি, আমাদের উভয়ের সম্মতিতে হয়েছিল, সওদা ছিল দুইটা, এক, আমি তার দেনমোহর এর এক লাখ টাকা মওকুফ করবো, তার বিনিময়ে সে মেয়েকে আমার কাছ থেকে নেবে না।
এবার এক গল্প বলি, জীবনের গল্প, ভালবাসা কী তা আমি তার সংসারে বুঝিনি, মাত্র ১৬ বছরে আমার কোলে আমার মেয়ে এসেছিল, দুটো সন্তানকে কোরবানি দেবার পর। তখন এমআর কী তাই বুঝতাম না, বুঝলে হয়তো আজ আমার ঘর জুড়ে ওদেরও কোলাহল থাকতো, মা শুধু পড়াশোনা আর বাসার মাঝে আটকে ফেলেছিল, খুব বেশি বুঝি না, মফস্বলে বড়ো হয়েছি, পৃথিবী চেনার আগেই বিশাল এক সংসার, সন্তান.. ১২ হাত শাড়ি সামাল দিয়ে, কাঠের, লাকড়ির চুলায় ১২ জনের রান্না.. একদিকে মেয়ে কাঁদে, আর একদিকে সংসার, তাও স্বামী ছাড়া সংসার, সে তখন ঢাকাতে কাজ করে, দুই মাসে একবার আসে, এসে সেই ঝগড়া, মারধোর।
তার পিছে যুক্তি ছিল বটে, ম্যানেজমেন্ট এ মাস্টার্স করা ছেলে, বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি থেকে একে তো কিছু পেল না, তার উপরে শুকনা কাঠি মার্কা এক কালি মেয়ে, একটা মেয়ে জন্ম দিসে, এইসব একটা শিক্ষিত ছেলে কীভাবে মেনে নেবে? যাও নিল, ভাল কথা, রাতের বেলা এই কালির মুখ দেখলে তার যে আর মেতে উঠতে মন চায় না। নিজের চোখে-মুখে হাত নাড়িয়ে নিজেকে নিজের রঙ আর রুপের আহাজারিতে নিজেই কুড়ে কুড়ে নিজেকে আঘাত করেছি, মা এর ছেলে বাড়ি আসাই বন্ধ করতে বসেছে।
ধীরে ধীরে সব যেন দিন দিন শুকিয়ে গেল, সংসার এর স্বপ্ন আমার শেষ, কত রাত, কত দিন, কত মুহূর্ত শুধু নিজের ভুলটুকু খুঁজে বেড়িয়েছি, বাবা ছাড়া মেয়ের শৈশব কী নিদারুণ শূন্যতায় পার হয়ে গেল, এই কঠিন সমাজের পিষাপিষিতে মেয়ে আমার সময়ের আগেই কত বড়ো হয়ে উঠেছে।
তালাকের কাগজটা হাতে নিয়ে আজও ভাবি, ভুলটা কী ছিল? মাঝে মাঝে ভাবি, হয়তো ঘুমিয়ে আছি, ঘুম ভাঙলে আমি অন্য আমি হয়ে যাবো, যেখানে সে সময়গুলি শুধুই রূপকথার রাক্ষসপুরির গল্পের মতো হবে…।