আবারও সেই মেয়েগুলো

উইমেন চ্যাপ্টার: নারী ফুটবল টিম আবারও আলোচনায়। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে এবার ভারতের কাছে লড়াই করে হেরে রানার আপ হয়ে দেশে ফিরেছে আমাদের মেয়েরা। কিন্তু তাদের আনতে সেদিনও কেউ যায়নি বিমানবন্দরে, ফুল তো দূরের কথা। এটাই প্রথম নয় এমন ঘটনা। আমি কোনো তুলনা করছি না, তারপরও বলছি, দেশের হয়ে জয় ছিনিয়ে আনা, তা সে যে প্রতিযোগিতাতেই হোক না কেন, আনন্দ তো সমানই হওয়ার কথা।

কিন্তু না, আমাদের দেশে এক ক্রিকেট ছাড়া আর সব খেলাধুলাই অসবর্ণ গোত্রের। সবাই যার যার জায়গা থেকে সব ধরনের প্রতিকূলতাকে জয় করেই এগিয়ে যায় দেশের পতাকা সমুন্নত রেখে। অথচ তাদের প্রাপ্তি? তাদের প্রতি কর্তৃপক্ষের আচরণই বলে দেয় সব। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে যেন এটা আরও বেশি বেশি প্রযোজ্য।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) কর্মকর্তাদের বলছি, আপনাদের সমস্যাটা কোথায় বলবেন একটু? জাতীয় পুরুষ ফুটবল টিম যখন ভূটানের সাথেও জিততে পারে না, সেখানে মেয়েগুলো এমন একটি সাফল্য নিয়ে এলেও আপনারা দিব্যি নাকে তেল দিয়ে ঘুমান। আর কতো ঘুমাবেন আপনারা?

আপনাদের যে হারে উদরপূর্তি হয়েছে, তাতে করে তো ফুল কেনার টাকার অভাব হওয়ার কথা না? যতদূর জানি, আপনারা ঠিকই দামি গাড়িতে চড়েন। রাষ্ট্রের কিংবা ফিফার টাকায় দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান। আপনাদের ছেলে-মেয়েরাও তার সুযোগ নিতে ভুল করে না, বা আপনারা ভুল করতে দেন না।

তাহলে এই যে মেয়েগুলো, সাক্ষাত গ্রামের মেয়েগুলো যখন এতোবড় একটা অর্জন শেষে দেশের সুনাম কামিয়ে দেশে ফিরলো, অভিভাবক হিসেবে আপনাদের কি উচিত ছিল না, ওদের অভ্যর্থনা জানানোর? এতো হীন মানসিকতা কেন আপনাদের?

আচ্ছা আপনারাই বলুন, এই মেয়েগুলো কি আর দশটা মেয়ের মতোনই সাধারণ? ওরা তো অসাধারণ। ওদের সাথে থাকে পতাকা, বুকে থাকে দেশ, বাংলাদেশ। আর তাকে বলেই মাবিয়ার মতোন মেয়েরা ভারোত্তলনে সোনা জিতে জাতীয় সঙ্গীতের সাথে কান্নায় ভেঙে পড়ে, ওর সাথে সাথে আমরাও কাঁদি, যদিও আমি নিশ্চিত যে, আপনাদের কোনো বিকার হয় না এতে। সেই মাবিয়া যখন স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ফিরে এসে দেখলেন কেউ তার জন্য অপেক্ষায় নেই,  সীমান্তে কেউ ছিল না তাঁকে একটু বরণ করার!

তখন তিনি মিডিয়ার কাছে মন্তব্য করেছিলেন-  ‘নিশ্চয়ই কোনো ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে দেখে আমাদের ফেরার দিনটা কারও মাথায় ছিল না। দেশকে সোনার পদক জিতিয়েছি, এটাই আমার আনন্দ। সোনার পদক জিতেই আমি অনেক সম্মানিত। বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে একটা ফুলের মালা না হয়, না-ই বা পেলাম’!

মাবিয়া সংবাদ মাধ্যমকে আরও বলেছিলেন, ‘দেশ থেকে উচ্চ পর্যায়ের কারও একটা ফোন পেলে খুব ভালো লাগতো। আমরা তো দেশের জন্যই খেলি। সবসময় সঙ্গে থাকে লাল-সবুজ পতাকা। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলেনি। হয়তো তাঁদের সময় হয়নি। তবে কারও বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।’

তবে সোশ্যাল মিডিয়াতে এ নিয়ে তখন ঝড় উঠার পর জাতীয় ক্রিকেটারদের কয়েকজনও এর সমালোচনা করেছিলেন। আর তার ফল হিসেবে পরদিন মাবিয়ার বস্তিবাড়িতে মিডিয়া উপচে পড়েছিল।

এসবকিছুই আসলে কর্তৃপক্ষের মোটা মাথায় ঢোকার কথা না। স্বার্থ ছাড়া তারা এক পাও নড়তে নারাজ। আর বিষয়টি যখন মেয়েদের কেন্দ্র করে, তখন তো তারা আবার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ হয়ে ওঠেন।

কিন্তু গ্রামের যে কোচ জীবন তুচ্ছ করে, কোনোকিছু প্রত্যাশা না করে এতোগুলো মেয়েকে খেলার মাঠে নিয়ে আসেন, তৈরি করেন ফুটবলার হিসেবে, তৈরির পর ওদেরকে আমাদের সামনে উপস্থিত করেন, বলেন যে, দেখো, কী বানিয়েছি আমি গ্রামের মাটি দিয়ে, আর সেই মেয়েরা যখন একের পর এক চমক সৃষ্টি করে দেখায়, জাতীয় পতাকাকে সমুন্নত রাখে, সেই কোচের কিন্তু বিকার হয় ওদের সাফল্যে। দিব্যচোখে দেখতে পাই, সেই কোচের তখন চোখ বেয়ে জলের ধারা নামে। কিন্তু উনার সামর্থ্য নেই বিমানবন্দরে মেয়েগুলোকে বরণ করে নেয়ার। উনিও দরিদ্র মানুষ।

শুনলাম এবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাফুফে থেকে কোনো কর্মকর্তাই যাননি। স্টেডিয়ামে তাদের উৎসাহ দেয়ার মতোনও কেউ ছিল না। মেয়েগুলোও হয়েছে আমাদের। জীবনভর বঞ্চনা আর শোষণের মধ্যে থেকে ওরাও ভুলেই গেছে কিছু আশা করার কথা।

গেলবার ওরা যখন জয়ী হয়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছিল সাধারণ লোকাল বাসে করে, তখন কিছু উচ্ছৃঙ্খল লোকজন তাদের সাথে খারাপ আচরণ করেছিল। তখনও তাদের ভাগ্যে আলাদা কোনো বাহন জোটেনি। সামান্য টাকাতেই তাদের বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে তুমুল সমালোচনার কারণে আবারও ঢাকায় আসার পথে তাদের জন্য আটটা গাড়ি পাঠানো হয়েছিল।

এসব শুনলে কাঁদবো, নাকি হাসবো, ঠিক বুঝতে পারি না। এই উদ্যোগটা নেয়ার জন্য সমালোচনা হতে হলো কেন? নিজেদের মাথায় কি কেবলই গোবর?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.