নিলামে পাঁচটি শব্দ

ইয়াসির মনন

: সিএনজির ভাড়া দিয়ে দৌড়ে রেলস্টেশনের ভিতরে ঢুকলো সিহামরাস্তায় জ্যামের কারণে দেরী হয়ে গেছে। মেজাজটা খারাপ করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিজের প্ল্যাটফর্মটা খুঁজতে লাগলো সে। সাইনবোর্ড দেখে চট্টগ্রামগামী ট্রেনের দিকে এগিয়ে গেল, হাতের টিকেটটার ভাঁজ খুলে একটা বগীর সামনে গিয়ে থেমে গেটের সাথে লাগানো নাম্বার গুলায়ে চোখ বুলিয়ে দেখতে থাকলো। তারপর স্বস্তির একটা হাসি হেসে উঠে পড়লো বগীটায়। ছোট একটা কেবিন। উপরে নিচে মিলিয়ে চারটা সিট। মানে স্লিপিং সিট।  একজন পা উঠিয়ে আরাম করে বসার বা শোয়ার জন্য যথেষ্ট। ট্রেনে কখনই ঘুমাতে পারে না সিহাম।  আসলে জার্নি করার সময়ে ঘুমাতে পারে না সিহাম, না বাসে, না ট্রেনে।  আর তার মধ্যে মোবাইলের জ্বালা তো আছেই। হয় একটু পর পর অফিসের ফোন আসবে, না হয় বাসার ফোন। সারা পথ জেগে থাকলেও সময় ঠিকই কেটে যায় তার। আধা ঘন্টা-এক ঘন্টা পর পর একটা সিগারেট খেয়ে আসা যায় কেবিন থেকে বের হয়েই।  

ছবিটা প্রীমা নাজিয়া আন্দালিবের আঁকা

পুরা কেবিনটাই খালি। সপ্তাহের মাঝখান। তাই হয়তো যাত্রী কম। ‘যাক ভালোই হলো, সারা রাস্তা কেবিনেই সিগারেট খাওয়া যাবে’, ভাবলো সে।  

দরজার সামনে দিয়ে টিটি যাচ্ছিলো, ‘এক্সকিউজ মি’ বলে সামনে এগিয়ে গেল সিহাম, ‘আচ্ছা, এই কেবিনে কি আরও কেউ উঠবেন?’ টিটি হাতের ক্লিপবোর্ড থেকে একটা কাগজে চোখ বুলিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ, একজনের টিকেট কাটা আছে, তামান্না আলম’ বলেই চলে গেল টিটি। কেবিনে সিগারেট খাওয়া যাবে না ভেবে প্রথমে মন খারাপ হলেও, সহযাত্রী একজন মহিলা, এটা ভেবে অনেকটা খুশিই হলো। আর ‘তামান্না আলম’ নামটা কোথায় যেন শুনেছে-মনে করার চেষ্টা করলো। চেনা চেনা লাগছে নামটা।  কিন্তু মনে করতে পারলো না। পরে ভাবলো, সারা দেশের সব মেয়েকেই তো তার পরিচিত মনে হয়।

চিটাগাং এর মামা সিহামের বিয়ের জন্য একটা মেয়ে দেখেছেন। আর সাথেই সাথেই চলে আসতে বলেছেন সিহামকে চিটাগাং এ। মায়ের তিন দিনের খাবারের অনশন আর বাবার অসহযোগ আন্দোলনের ফলে অবশেষে বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করে সিহামআজ বিয়ের পাত্রী দেখার জন্য চিটাগাং যাচ্ছে সে। পাত্রী দেখার পর কী বলে বিয়ে রিজেক্ট করবে, তার প্রায় ২৮ টা বাহানা সে মাথায় গেঁথে রেখেছে। ইতিমধ্যে ১৮ টা পাত্রী দেখার এক্সপেরিয়েন্স আছে তার, আর এই বাহানাগুলা দিয়েই আগে পার পেয়েছে। আসলে পাত্রী দেখার পর চিটাগাং এর বন্ধুদের সাথে কী কী করবে, তার একটা বিশাল প্ল্যান নিয়ে যাচ্ছে সে।

ট্রেন ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে সিহামের সহযাত্রী কেবিনে এসে উপস্থিত। ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়সের মেয়ে হবে। মেয়েটার চেহারা দেখে হকচকিয়ে উঠলো সে। আরে, এটা তো কালকের ঐ মেয়েটা। মতিঝিলের এক ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অতিথি ছিল। পেশাগত কারণে ঐ অনুষ্ঠান কভার করেছিল সিহামসাংবাদিক সে। খুব ভালো বক্তব্য দিয়েছিল মেয়েটা গতকাল। ‘তামান্না আলম’ – এজন্যই নামটা এতো পরিচিত লাগছিল।

মুখ না ঘুরিয়ে চোখ বাঁকা করে মেয়েটাকে দেখার চেষ্টা করলো সে। খুব সুন্দর চেহারা। ফর্সা মুখটাকে দুইপাশে লম্বা কালো চুল ঢেকে রেখেছে। পরনে সাদা সালোয়ার কামিজ। কপালে ছোট্ট একটা টিপটকটকে লাল টিপ। এরকম মায়াবী চেহারার কাউকে সিহাম খুব কমই দেখেছে। আরেকবার মেয়েটার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল।

‘কী দেখছেন এভাবে বারবার? কিছু বলতে চাচ্ছেন?’ জিজ্ঞ্যেস করলো মেয়েটি।

‘না … মানে …’ চমকে উঠে কথা জড়িয়ে আসতে লাগলো সিহামের।

‘মানে কী?’ ভ্রু কুঁচকে তাকালো মেয়েটি।

‘না, আসলে গতকালকে আপনি যেই অনুষ্ঠানের অতিথি ছিলেন, আমি সেটার কভার স্টোরি করেছিলাম, আমি সিহামমানে আমি সাংবাদিক।’ নিজেকে সামলে নিয়ে বললো সে।

‘ও তাই নাকি?’ বলে হাসলো মেয়েটি, ‘আমি তামান্না’, বলে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ড শেক করলো সে

যতই ট্রেনের গতি বাড়তে থাকলো, তাদের কথাও বাড়তে লাগলোএকটার পর একটা টুকটাক প্রশ্ন করা শুরু করলো সিহামসাংবাদিকতা যেন মাথায় জড়ো হয়েছে। একথা সে কথার পরে সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি এখনও বিয়ে করেননি কেন ?’ বলেই সিহাম বুঝতে পারলো ভুল প্রশ্ন করে বসেছে। তামান্না কিছুক্ষণ চুপ করে সিহামের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর বলা শুরু করলো, ‘আমার নামের অর্থ জানেন? ইচ্ছা। তামান্না মানে ইচ্ছা, উইশ। আমি আমার নিজের ইচ্ছামতো কখনো কিছু করতে পারিনি। নিজের জন্য, নিজের ইচ্ছামতো কিছু করতে চাই আমি, তাই বিয়ে করিনি’ বলে হাসে সে।

‘মানে? ঠিক বুঝলাম না?’ অবাক হয়ে তামান্নাকে জিজ্ঞেস করে সিহাম

‘আমি রংপুরের এক ছোট্ট শহরের মেয়ে। শহর বললে ভুল হবে। ছোট একটা গ্রামের মেয়ে। ছোট গ্রামের মেয়েদের বড় স্বপ্ন দেখার অধিকার থাকে না। আমারও ছিল না। আমার মায়ের তিন মেয়ে। এটা তাঁর এমন একটা গুনাহ, যার দোষ তাঁর নিজের না। তাও প্রতিটা পদে পদে আমার মা’কে শাস্তি পেতে হয়েছে। আমাদের ওখানে মেয়েদের পড়ানো হয় শুধু এইজন্য, যাতে সে বিছানায় বসে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে পারে। আমার সায়েন্স ভালো লাগতো। কিন্তু ঘর থেকে বললো আর্টস নিয়ে পড়তে। আমার সাঁতার শেখার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ঘর থেকে বসিয়ে রাখতো পাশের বাসার মহিলাদের হাতে মেহেদী দেয়া দেখার জন্য। বলতো, পড়ে কাজে লাগবে। আমি চাইতাম স্বপ্ন দেখতে, আকাশে উড়তে। আর ঘর থেকে চাইতো আমার বিয়ে দিয়ে তাদের দায়িত্ব থেকে মুক্তি

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বললো তামান্না ।

‘হুমম…’ বলে এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে সিহামএরই মধ্যে কেবিনের দরজায় টোকা দেয় সার্ভিসের লোক। সে দুটা চায়ের অর্ডার দিয়ে নিজের সিটে এসে বসে। তামান্নার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘ তারপর?’

‘তারপর আর কি!’ মুচকি হেসে জবাব দেয় তামান্না, ‘তারপর প্রতি সপ্তাহে নিলাম হতে থাকলাম আমিনিলামকারী ভালো ছেলেরা তাদের পরিবার নিয়ে দেখতে আসতো আমাকে।‘ মুখে হাসি নিয়েই বলতে থাকে সে,’যেদিন ছেলে পক্ষ আসতো, ঘরের সব বিছানার চাদর পাল্টে যেত। পাল্টে যেত ঘরের পর্দাগুলি। মাঝে মাঝে ভাবি, আমিও যদি পাল্টাতে পারতাম। বিশেষ দিন ছিল সেগুলো। শোকেস থেকে নতুন চায়ের কাপ নামানো হতো। আর লাল একটা শাড়ি দিয়ে আমাকে পেঁচিয়ে শোপিসের মতো রাখা হতো বরপক্ষের সামনে। বাবা-মা তাদের সামনে আমার এমন সব গুণের প্রশংসা করতেন, আমি নিজেও জানতাম না ওসব গুণ আমার আছে। ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকতাম।

ইন্টারভিউ এর মতো প্রশ্ন হতোপছন্দ-অপছন্দ জিজ্ঞেস করতো। কারও ‘সবজি পছন্দ করে’ এমন বউ পছন্দ, কারও বা পুরা নন ভেজ। কারও গৃহিণী বউ পছন্দ , কারও বা চাকরিজীবী বউ । নিজেকে প্রোডাক্ট মনে হতো , যার মার্কেট ভ্যালু বর পক্ষ ঠিক করবে । আর এতো কিছুর মধ্যে আমার শুধু পাঁচটা শব্দ বলার অনুমতি ছিল তাও একটা কারণে । যাতে কেউ এটা না ভাবে পাত্রী বোবা। জানেন ? ঐ পাঁচটা শব্দ কি ?’ হঠাৎ সিহাম কে প্রশ্ন করে তামান্না।

একটা ঘোরের মধ্যে থেকে যেন কথাগুলি শুনছিল সিহামভিতরে ভিতরে কেমন যেন একটা অস্থির অস্থির লাগছিল। তামান্নার কথায় চোখের সামনে মনে হচ্ছিল ঐ মেয়েগুলোর চেহারা ভেসে উঠছিল একটু পরপর, যাদের কোনও না কোনও কারণ দেখিয়ে বিয়ের প্রপোজাল রিজেক্ট করেছিল সে।

‘না, জানি না’ মাথা নাড়ায় সে।

‘চায়ে কয় চামুচ চিনি নিবেন?’ বলে হা হা করে হেসে উঠে তামান্না।

‘মানে? ‘ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে সিহাম

‘চায়ে কয় চামুচ চিনি নিবেন – এই পাঁচটা শব্দ বলার অনুমতি ছিল আমার নিলামের সময়েশুধু এই পাঁচটা শব্দ। ‘ সিহামের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে তামান্না।

‘প্রতিবারই সামনা সামনি বেশ প্রশংসা করতো নিলামকারীরা। চলে যাওয়ার দু’এক দিনের মধ্যে কাউকে দিয়ে খবর পাঠাতো। একেকবার একেক বাহানা। নতুন নতুন বাহানা। প্রতিবার ছেলেপক্ষ ‘না’ বলে যেত, আর বাবা রাতের বেলা নেশা করে এসে মা’কে মারতো। যে ছেলেপক্ষের উপর বেশি আশা থাকতো, রিজেক্ট হয়ে যাওয়ার পর বাবা-মা’কে আরও বেশি মারতোআমাদের তিন বোন আর মা’কে বাবা অপয়া বলে ডাকতো।’

সিহাম নির্বাক শ্রোতার মতো শুনে যাচ্ছিল। তাকাতে পারছিলো না মেয়েটার দিকে। লজ্জায় নাকি কষ্টে, জানে না।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলা শুরু করলো তামান্না। ‘যখন তেইশ বার আমার নিলাম অসফল হলো, সেদিন রাতে বাবা আমার গায়ে হাত তুললেন। যার দাগ এখনও আমি বয়ে বেড়াচ্ছি আমার চেহারার সাথে ‘।

কথাটা শোনামাত্র চোখ তুলে তাকালো সিহামএবার খেয়াল করলো মেয়েটার কপালের বাম পাশে একটা ছোট দাগ। পুরানো সেলাই। লম্বা কালো চুলগুলো দিয়ে ঢাকা থাকায় এতোক্ষণ চোখে পড়েনি। খুব ভালো করে না দেখলে বোঝাও যায় না। কিন্তু বোঝা যায় এই ক্ষতের ব্যাথা।

‘আমি আমার মায়ের মতো জীবন চাইনি। আমি আর চাইনি প্রতি সপ্তাহে সপ্তাহে নিলাম হতে। সেই রাতেই আমি ঘর ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আর তারপর আমি কী হয়েছি, তা আপনার সামনেই আছি, হয়তো দেখতে পাচ্ছেন’।

ইয়াসির মনন

‘আপনার মা? তিনিও এসেছিলেন আপনার সাথে?’ জিজ্ঞেস করে সিহাম

‘না, অনেকবার বলেছি, মা তাঁর সংসার ছেড়ে আসেননি’, বলে আনমনে ট্রেনের কেবিনের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায় তামান্না। ‘জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছাড়েনি মা তাঁর সংসার সেই নিজের সংসার, যা তাঁকে কখনও নিজের মনে করে নাই।’

সিহাম ঠিকমতো তাকাতে পারছে না তামান্নার দিকে। তার বারবার মনে হচ্ছে সামনে মেয়েটা নেই, একটা আয়না আছে। যেই আয়নায় নিলামকারী হিসেবে সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। নিজের এমন একটা রুপ দেখছে, যেটার ব্যাপারে এর আগে তার কোনও আইডিয়াই ছিল না।

সে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো আর তার মা’কে এসএমএস পাঠালো – ‘মা , আমি পাত্রী দেখতে যাবো না। আর কোনও নিলামে অংশ নিবো না’।

আবার কেবিনের দরজায় নক। সার্ভিসের লোক। চা এর ট্রে নিয়ে এসেছে।

তামান্না এখনও তাকিয়ে আছে জানালার বাইরের ছুটে যাওয়া প্রকৃতির দিকে। লোকটাকে বিদায় দিয়ে চা এর ট্রে মাঝখানে রেখে তামান্নার মুখোমুখি বসলো সিহাম, আর হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, ‘চায়ে কয় চামুচ চিনি নিবেন?’

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.