
আরিফ জেবতিক (১১ জুলাই): ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষার্থীদের একাংশ সরকারি চাকুরিতে জেলা কোটা ছাড়া বাকি সব কোটা তুলে দেয়ার দাবি জানিয়ে গতকাল থেকে আন্দোলন শুরু করেছেন। যেকোনো আন্দোলন শুরু হওয়া মাত্রই তার পক্ষে বিপক্ষে জনমত তৈরি হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক এবং নেটচারিরা স্বাভাবিক ভাবেই আন্দোলিত হবেন। আন্দোলনকারীদের একটি বড় অংশই অন্যান্য কোটার মাঝে মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য কোটার প্রতি তাঁদের ক্ষোভ বেশি প্রকাশ করছেন। সেখানে হতাশ তরুণরা যেমন আছেন তেমনই তাঁদের ক্ষোভকে উস্কে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করার রাজনৈতিক চালবাজরাও যে সুযোগ সন্ধান করছেন সেটা সহজেই বলে দেয়া যায়। তবে এসব রাজনৈতিক ভেলকিবাজদের দূরে রেখেও যদি বিবেচনা করা যায়, তাহলে আমার মতে দেশে মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য কোটার সংখ্যা অবশ্যই পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।
প্রথম কথা হচ্ছে মুষ্টিমেয় কয়েক হাজার রাজাকার বাদে গোটা সাড়ে ৭ কোটি বাঙালিই মুক্তিযোদ্ধা। ৭০ এর নির্বাচনী এজেন্ডার ৬ দফা স্পষ্টতই তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝের বৈষম্যকে সামনে তুলে এনেছিল এবং সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের উন্মেষ ঘটার পক্ষে জনমত ছিল একচেটিয়া। সেই জনমতের কারণেই পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা এই দেশে একটি প্রতিকূল পরিবেশে পড়ে অন্যদিকে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গোটা বাংলাদেশ হয়ে পড়ে সহজ চারণ ভূমি।
আমরা যদি এই সত্যটি মেনে নেই, তাহলে একথা সত্যি যে রাজাকার বাদে প্রতিটি পরিবারেরই ত্যাগ আছে মুক্তিযুদ্ধে। তবে সশস্ত্র যুদ্ধ মানুষকে অনেক এলেমেলো করে দেয়। জীবন হাতে নিয়ে যুদ্ধ করা এসব মানুষ যাতে জীবন যুদ্ধেও বিজয়ী থাকেন, সেটি দেখভাল করা অবশ্যই এই জাতির দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটার উদ্ভব।
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় বাংলাদেশে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংখ্যা কত? এস ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ তাঁর বই ” “” “Bangladesh in Liberation War””য়ে জানিয়েছেন যে ১১ সেক্টর নিয়ে তৈরি মূল ফোর্সে সেই সংখ্যা ৮০ হাজার। এর বাইরে মুজিব বাহিনী ১০ হাজার, কাদেরিয়া বাহিনীর ৫ হাজার এবং হেমায়েত বাহিনীর সদস্য ছিল দেড় হাজার। অন্যান্য ক্ষুদ্র বিভিন্ন দল মিলে আরো ১০ হাজার। এই হিসেবে মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা শফিউল্লাহর হিসাবে ১ লক্ষ ৫ হাজার।
মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি শুরু হয় ১৯৮৭ সালে সেখানে ৬৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালের বিএনপি সরকারের তালিকায় ছিল ৮৩ হাজার, ১৯৯৯ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ১.৫৪ লাখ এবং ২০০২ সালের ৪ দলীয় জোট সরকারের সময়ে গেজেট করে ১.৯৮ লাখ ( প্রায় ২ লাখ) লোককে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
আমরা যদি তর্কের খাতিরে এই সর্বোচ্চ সংখ্যা ২ লাখকেই বিবেচনায় নেই, এবং ১৯৭১ সালের সাড়ে ৭ কোটি জনসংখ্যার মাঝে ২ কোটি মানুষকে সশস্ত্র যুদ্ধে সক্ষম বয়স্ক ধরে নেই ( এটি আমি সম্পূর্ণ অনুমানে ধরে নিচ্ছি, ভিন্নমত থাকলে যুক্তি পেশ করতে অনুরোধ করলাম।) তাহলেও সক্ষম জনগোষ্ঠির মাত্র ১% মানুষ সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বলে মনে হয়।
সক্ষম জনগোষ্ঠির এই ১% এবং মোট জনগোষ্ঠিকে ৭ কোটি ধরলে মোট জনসংখ্যার ০.০০৩% মানুষের পরবর্তী জীবনের দেখভাল করার দায়িত্ব স্বাধীন জাতির বাকি অংশের এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। এদের মধ্যে অনেকেই দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেয়েছেন, আহত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেয়েছেন। এবং সক্ষম মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার দেয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকেই সরকারি চাকুরিতে কোটা প্রথা চালু করা হয়েছে।
এ কথা সত্যি যে সরকারি চাকুরিতে যোগ দেয়ার আগ্রহ কিংবা পারিপার্শিকতা আমাদের অনেক মুক্তিযোদ্ধারই ছিল না। অসংখ্য কৃষক শ্রমিক এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পুরোনো জীবনে ফিরে গেছেন। তাঁদের সন্তানরা যাতে অন্তত ভালো থাকে সেজন্য পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটা প্রবর্তন করা হয়েছে যেটি খুবই যৌক্তিক পদক্ষেপ ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্মের জন্য কোটা সংরক্ষনের বিষয়টিও যখন বিবেচনা করা হয়, তখন এর হার যৌক্তিক ভাবে বিবেচনার অবকাশ ছিল। সেটি করা হয়নি বলেই আজকের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
১% জনগোষ্ঠির উত্তরাধিকারদের জন্য ৩০% কোটা সংরক্ষন গানিতিক ভাবেই অযৌক্তিক বলে আমার কাছে মনে হয়। সেটা বিবেচনায় না আনায় দেখা যায় বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূর্ণ হয় না এবং পরবর্তীতে গত বছর স্পেশাল বিসিএস নিতে হয়েছে। সেই জটিলতা এড়াতে এবার প্রিলিমিনারী থেকেই কোটা অনুযায়ী ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে এবং সেটি আবার নতুন করে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
আমার বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধার তৃতীয় প্রজন্মের জন্য কোটা সংরক্ষণ যদি বিবেচনা করতেই হয় সেই কোটার হার খুবই কম হওয়া প্রয়োজন। জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার সম্মানজনক ভাতা এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে, কিন্তু ৩০% কোটা নির্ধারণ বাস্তবতা নির্ভর হয় না।
তবে আমি জনপ্রশাসনে কোটা তুলে দেয়ার পক্ষে নই। নারী, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠি, শারিরীক ভাবে চ্যালেঞ্জড এবং নারীদের জন্য কোটা সংরক্ষন জরুরি। এর পাশাপাশি কৃষক এবং শ্রমিকের সন্তানের জন্যও কিছু কোটা রাখার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে, কারণ তাঁরা মধ্যবিত্তের তুলনায় অনেক প্রতিকূলতার মাঝে থেকে নিজেদের সন্তানকে পড়াশোনা করান, তাঁদেরকে উৎসাহিত করলে শিক্ষার বিস্তার বাড়বে।
এর বাইরে যাঁরা পরিবার পরিকল্পনা করেন তাঁদের জন্যও কিছু কোটা থাকতে পারে। দুটি সন্তানের অধিকারী বাবা-মায়ের সন্তানরা সেই কোটার সুযোগ পাবেন, এতে করে দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনের গুরুত্বও প্রচারিত হবে।
ফুটনোট- ১: আমার লেখা থেকে কেউ যাতে মনে না করেন যে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করার কোন চেষ্টা করছি। বরং আমি মনে করি এত বেশি সংখ্যক কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা থাকলে বর্তমান প্রজন্মের মাঝে হতাশা আসতে বাধ্য। সেই হতাশার সুযোগ নিয়ে সুযোগ সন্ধানীরা আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশকে বিরূপ মনোভাবাপন্ন করে তোলার চেষ্টা করলে সেটা খুবই দুঃখের ব্যাপার হবে।
ফুটনোট- ২: ফেসবুকে দেখলাম কেউ কেউ জানিয়েছেন আজকে শাহবাগে আন্দোলনকারীরা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে গালি দিয়ে স্লোগান দিয়েছে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি এটা বিশ্বাস করিনি। এত দুঃসাহস যদি কেউ দেখায় তাহলে উপস্থিত বাকিরা তাকে পিটিয়ে ছাতু করে দেয়ার কথা। তবে এরকম যদি সত্যিই ঘটে থাকে, তাহলে এর পরিণাম যে সুখকর কিছু হবে না, সেটিও বিনীত সুরে হুশিয়ারি দিয়ে যাই।