যাবতীয় বিনোদনে নারীদেহ কি মদের সাথে চানাচুর!

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী: বহুদিন আগে বিটিভিতে হুমায়ুন আহমেদ রচিত একটি নাটকের জনপ্রিয় সংলাপ মনে পড়ে গেল-
” হাসতে পারলাম না বলে দুঃখিত। “

পায়ে পাড়া দিয়ে গোল বাঁধিয়ে নারীবাদী হওয়ার কোনো উদ্দেশ্য আমার কোনোকালেও ছিল না, আজো নেই। অবশ্য পৃথিবীর বুকে মানুষ হিসেবে আমার স্বাধীন অস্তিত্বকে যদি কেউ নারীবাদ বলে ধরে নেন সেক্ষেত্রে কিছু বলার নেই।

হাসি -ঠাট্টা -তামাশা থেকে গালিগালাজ, নির্যাতন – ধর্ষণ – পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ে যদি নারীদেহই হয় প্রধান উপজীব্য তাহলে আপনারাই বলুন হাসতে পারার কোনো কারণ আছে কী?
গালি দিতে গেলে মেয়ে দরকার হয়, রসিকতা করতেও “মেয়ে মানুষ” নিয়ে অশালীন কথা না বললে জোকসটা ঠিক “ডার্টি ” হয়না, তা নাহলে আবার ঠিক জমেও না।
জানতে আগ্রহী – কেন?  যাবতীয় বিনোদনে নারীদেহ কী মদের সাথে চানাচুর?

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী

কর্মজীবনের শুরুর দিকে আমি দেখেছি, সহকর্মীদের মাঝে কোনো বিবাহিত নারী যদি সকালে স্নান করে কর্মস্থলে আসেন, পুরুষ সহকর্মী তার দিকে রসিকতার অসভ্য ইংগিত ছুঁড়ে দেয় যে রোজই তিনি স্নান করে আসেন ! তাহলে নিশ্চই রোজই.. একবার একজন এর প্রতিবাদ করাতে উল্টো তাকে কিছু অসম্মানজনক কথা শুনতে হয়েছিলো।

চেনাজানা পুরুষদের মধ্যেও দেখেছি, অন্যের প্রেমিকা দেখলে মুখটা সুড়সুড় করে তার দৈহিক গড়ন নিয়ে কিছু বলতে। যে যত স্ল্যাং সে ততো স্মার্ট! সে ততো রসিক!

এরাই আবার নিজের কিশোরী বোনকে, “ওড়না ছাড়া বাইরে যাবে না “- বলে চোখ রাঙায় , নিজেরা গার্লস স্কুলের সামনে সিটি বাজায় আর বোনের বাইরে খেলাধুলাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

: সুজনের সাথে নয়া “মাল টা” কে রে? নতুন “জিএফ” নাকি?
“ঝাক্কাস” জিনিস কিন্তু”।

: “চাল্লু” মাল মামা। ওইটারে নিয়েই তো ঘুরে এখন। কোইত্থন যে জুটায়? শালা কপাল করে আইছে।

: আরে এইগুলা টিকতো না বেশিদিন বুঝলা? এই মাল অরে বিয়ে করবে ভাবছস! “সাত ঘাটের পানি খাওয়া জিনিস। খেয়াল করোনাই “পার্টস পাত্তির” অবস্থাও তো সুবিধার না!

:তুই তো শালা জীবন্ত মাইক্রোস্কোপ…

কথোপকথনটা যদি রাস্তার লোকের নোংরা আলাপ বলে মনে হয় তাহলে আপনি ভুল করবেন। আশেপাশে একটু চোখ কান খোলা রাখলে কথাগুলো খুব অপরিচিত মনে হবার  কথা না। আমাদেরই অতি পরিচিত কারো মুখে কী এই ধরনের অশালীন সংলাপ আমরা কখনো শুনিনি? বন্ধু (!) মহলে নিজের প্রেমিকা বা হালফ্যাশনের “জিএফ” এমনকি স্ত্রী বা নিছক বন্ধুত্ব আছে এমন কোনো নারীর উপস্থিতি ঘটলে অন্যান্যদের এই ধরনের মন্তব্য যেন গা সওয়া হয়ে গেছে আমাদের। এদের মধ্যে অনেকের মধ্যে আবার নিজেদের ভালো “জিনিসটা” না পাওয়ার আহাজারি, অন্যে কেন পেলো সেই ঈর্ষা এবং ফলাফল অবধারিত ভাবে আঙুর (নাকি তেঁতুল!!)  ফল টক। অগত্যা ওই মেয়ের শরীরে অণুবীক্ষণযন্ত্র লাগাও, দূরবীন ফিট করো, জীবনে প্রথম দেখা তাতে কী চরিত্রের ময়নাতদন্ত করে নিজের ভেতরের যত কাম- লালসা আছে সব নিবারণ করে শান্তি পাও।

এই বিকারগ্রস্ত লোকগুলো কিন্তু অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী নয়। নামীদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই লেখাপড়া করেছে বা করে তারা। এবং এই ধরনের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যকে কিন্তু স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়া হয়।
আবার কারো সাথে সম্পর্ক ভেঙে গেলে আজকালকার ছেলেমেয়েরা যাকে বলে “ব্রেক আপ” হয়ে গেলে যথারীতি সেই মেয়ে ছিল পুরোপুরি “দুই নম্বর”! কোনো চরিত্রই নেই! চাইলেই পাওয়া যায়!

ভালোবেসে বিয়ে করার পর বউ হয়ে যায় সম্পত্তি। নিজেদের ভেতর তর্কাতর্কি হলেই স্ত্রীকে কোণঠাসা করতে অতি আধুনিক স্বামী মহোদয়ও তার পূর্বসূরিদের দেখানো পথ ধরেই হাঁটবে। শিক্ষিত আর অশিক্ষিত পুরুষ বলে এখানে কিছু নেই। প্রকৃত শিক্ষাটাই যে কী তা বোঝার মতো শিক্ষাটাই যে এদের নেই! দিন বদলেছে, নারীর ক্ষমতায়নের জয়জয়কার চারদিকে।  গালিগালাজের ভাষা, ধরণ কিন্তু রয়ে গেছে সেই একই। যত বড় সতীসাবিত্রীই হও আর ক্যারিয়ারে যত বিশাল অর্জনই থাকুক না কেন চরিত্র তুলে অশালীন গালি দেয়ার সময় তা ধর্তব্য নয়। তখন একমাত্র কর্তব্য ভিকটিমকে  শায়েস্তা করা, তার মনোবল,আত্মসম্মানবোধ  ভেঙে চুরমার করা।

স্বামীর বর্বরোচিত নির্যাতনে দৃষ্টি হারানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোমানা মঞ্জুর স্বামীর আয়ের ওপর নির্ভরশীল অসহায় গৃহিনী ছিলেন না। তাঁর ঘাতক স্বামী হাসান সাঈদ অশিক্ষিত ছিলোনা – বুয়েটে পড়ালেখা করেছিলো সে।
অত্যন্ত মেধাবী ছাত্ররাই বুয়েটে পড়ার সুযোগ পায় বলে জানি। সেই শিক্ষিত , মেধাবী লোকই শিশুকন্যার সামনে রোমানা মঞ্জুরের দুই চোখে আঙুল ঢুকিয়ে খুবলে নিয়েছিলো। এরকম ভয়ঙ্কর অপরাধীর পক্ষেও সাফাই গেয়ে,  মায়া কান্না কেঁদে ফেইসবুকে প্রচারণা চালানো হয়েছিলো। সেখানেও রোমানা চরিত্রহীন এটাই ছিলো মোক্ষম অস্ত্র! ধিক্কার জানানোর ভাষা নেই।

শারমিন রীমার কথা কী কারো মনে আছে? সমুদ্র দেখানোর কথা বলে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে ফেরার পথে তার স্বামী মুনিরের হাতে খুন হয়েছিলেন। অপরাধ ছিলো  স্বামীর অন্য নারীর সাথে সম্পর্কের কথা জেনে ফেলা। সেই খুনি মুনিরও উচ্চশিক্ষিত পরিবারের সন্তান ছিল।

আমার বাড়িতে কাজে সাহায্য করে যে মেয়েটি প্রায়ই সে কেঁদে-কেটে চোখ- মুখ ফুলিয়ে আসে। এরকম দেখলে আমি প্রশ্ন করি বাড়িতে কিছু হয়েছে কিনা। তার রিকশাচালক স্বামী তাকে তার আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করতে দেয় না, গায়েও হাত তোলে অনেক সময়।

শুধু রিকশাওয়ালারাই বউ পেটায় আর বস্তির লোকই গালিগালাজ করে একথা এখন আর ধোপে টেকে না।

এমন অনেক তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্রলোককে আমি চিনি যাদের জীবনসঙ্গীর মুখে তাদের অত্যাচার আর মুখ খিস্তির কথা শুনলে হতভম্ব হয়ে যেতে হয়।

ছোটবেলা থেকে আমার মাকে দেখেছি পারিবারিক কলহে, নির্যাতনের ঘটনায় চেনা-অচেনা বহু মানুষের পাশে দাঁড়াতে। একবার এক পরিচিত প্রবাসী দম্পতির বিবাদ ডিভোর্সের পর্যায়ে চলে গেলে দুজনে মিলে মার কাছে এলো তাদের সমস্যা নিয়ে আলাপ করতে। আমরা অন্য ঘরে থাকলেও হাঁটাচলার ফাঁকে না চাইলেও কিছু কথা কানে আসছিল। তা থেকে বুঝতে পারলাম, পেশায় অধ্যাপক এই লোক তার স্ত্রীকে বাধ্য করে বাড়িতে সবসময় কাপড় না পরে থাকতে। যখন খুশি তখন শারীরিক ভাবে ধর্ষণ করে তাকে। এবং সেই সময়টাতে তাদের ছয় বছর বয়সী শিশু সন্তানকে বেঁধে রাখা হয় পাশের ঘরে।

কান্না বিজড়িত কণ্ঠে তার স্ত্রী যখন বর্ণনা করছিলো এই অমানবিক নির্যাতনের, অমানুষটা তখন একটা কাগজে গভীর মনোযোগের সাথে কবিতা লিখে চলেছে তাও আবার বউকে উদ্দেশ্য করে প্রেমের কবিতা!  একটু পরে আয়োজন করে তা আবার আবৃত্তি করে শোনাতে লাগলো! বিকৃতির কোন পর্যায়ে পৌঁছুলে মানুষ এহেন আচরণ করতে পারে আমার জানা নেই!

যুগে যুগে সার্কাসটা তো এভাবেই তো চলছে মেয়েদেরকে পুঁজি করে। যত্রতত্র, সর্বত্র। সিনেমাতে “আইটেম নাচ” এর “আইটেম”টাও বলা বাহুল্য সেই নারীই। এগুলোই নাকি শিল্প!

এসব দেখে শুনে মনে হয় আমি বোধহয় রামগরুড়ের ছানা হয়ে যাচ্ছি। রসবোধ, শিল্পবোধ কোনোটাই নেই। এগুলোকে যদি বিনোদন বলে চালানো হয় তাহলে তেঁতুল হুজুর আর কুখ্যাত রাজাকার সাঈদীর ওয়াজও ব্যাপক বিনোদন।

এই যে ইভটিজিং, অশ্লীল রসিকতা, গালি দেয়া এসবের মধ্যে দিয়ে বেশ তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে নির্বিকার “পুরুষতন্ত্র”। আজকের অসুস্থ মানসিকতা জন্ম দিচ্ছে আগামীর নির্যাতক প্রজন্ম। তাদের বিকৃত কাম-বাসনাকে নিবৃত্ত করতে শিকার হিসেবে বেছে নিচ্ছে বিপরীত লিংগের মানুষগুলোকে। কেউ অশ্লীল মন্তব্য ছুঁড়ে, কেউ ধর্ষণ করে, কেউ পতিতালয়ে গিয়ে, কেউ ব্ল্যাকমেইল করে, কেউ নির্যাতন করে নিজেদের ভেতরের কু-বাসনা চরিতার্থ করেই চলেছে।

প্রকৃত অর্থে নারীজীবন কতখানি ক্ষতবিক্ষত পুরুষতন্ত্রের নখের আঁচড়ে, বিষদাঁতের ছোবলে, তা অনুধাবন করার জন্য কোনো অণুবীক্ষণযন্ত্র প্রয়োজন নেই। দরকার নিজের বিবেককে, মনুষ্যসত্ত্বাকে জাগ্রত করার। যেখানে বিবেক জাগ্রত হয় না,  প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, সামাজিক অবস্থান সেখানে কোনোই ভূমিকা রাখতে পারছে না।

তাই পারিবারিক মূল্যবোধের প্রতি যত্নবান হওয়াটা জরুরি। প্রয়োজন মানসিক দীনতা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা।

দয়া করে মানুষ হিসেবে মানুষকে সম্মান করতে শিখুন আর নারীদেরকে মদের সাথে চানাচুর ভাবা বন্ধ করুন।

শেয়ার করুন: