সংস্কৃতি ও ধর্ম বনাম নারীর বস্ত্র

রিয়াজুল হক:

১.
কান পাতিলে প্রায়শ: শোনা যায় ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ কিংবা ’ধর্মীয় অনুশাসনের’ ধস নামিয়াছে। কীভাবে ইহা বোধগম্য বা দৃশ্যমান হইবে? সমাজের ভাষ্যমতে ‘ইহা বোধগম্য বা দৃশ্যমান হইবে নারীর দিকে তাকাইলে, অারো স্পষ্ট করিয়া বলিলে তাহাদের বেশভুষায়-পোশাক-পরিচ্ছদে’। তার মানে ধসের কারণ বা হেতু হইলো নারী! সকল অমঙ্গলের কারণ হইলো নারী (?)– ইহাই যুগে যুগে চাউর করা হইয়াছে বেশ সংগঠিতভাবে এবং প্রবলবেগে। আমাদের সাহিত্যে, নাটকে, সঙ্গীতে, পুঁথিতে, বয়ানে ইহার প্রতিচ্ছবি বা ছাপ আছে।

২.
এদেশের কিছু বাঙালি নারী বিশেষত (শহুরে, মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্তের) শাড়ির বদলে প্যান্ট-শার্ট-ব্লেজার-টি-শার্ট/ফতুয়া, সালোয়ার-কামিজ বা লেহেঙ্গা পরিধান করেন। প্যান্ট-শার্ট-কোট হইলো পাশ্চাত্যের পরিধেয় বস্ত্র। আর সালোয়ার-কামিজ-লেহেঙ্গা হইলো পাকিস্তান-ভারতের পরিধেয় বস্ত্র। তাই ‘বাঙালি সংস্কৃতির অার কিছু ‘অবশিষ্ট থাকিলো না’! আবার ‘বাঙালি বিশেষ করিয়া অনেক মুসলিম নারী হিজাব-বোরকা পরেন না’! অনেক ‘বিবাহিত হিন্দু নারী শাখা-সিদুঁর পরেন না’। ‘ইহাতে ধর্মের আবমাননা হয়, ধর্মীয় রীতিনীতির খেলাপ হয়’।

রিয়াজুল হক

৩.
কিন্তু, এদেশের অনেক বাঙালি পুরুষ যে ধুতি-লুঙ্গি-পায়জামা-পাঞ্জাবি-ফতুয়া ছাড়িয়া দিয়া প্যান্ট-শার্ট, কোট-ব্লেজার-স্যুট-টাই পরিধান করেন, তাহাতে কি বাঙালির সংস্কৃতির ধস নামে না বা ইতোমধ্যে নামে নাই? তাহাতে কি ধর্মের অবমাননা হয় না, ধর্মীয় রীতিনীতির খেলাপ হয় না, বা হয় নাই? বিবাহের সময় অনেক ছেলে যে আসকান-পাগড়ি পরিধান করেন, তাহাতে কি বাঙালিত্বের বদলে পাকিস্তানি-ভারতীয় সংস্কৃতির ছাপ থাকে না?

৪.
এমনকি শহরে-গ্রামে অনেক তরুণ ছেলে এখন শটস্-টিশার্ট পরিয়া জনপরিসরে ঘুরিয়া বেড়ায়। ইহাতে কি বাঙালির সংস্কৃতির বা শালীনতার বা পর্দার ক্ষতি হয় না? যদিও বাঙালি মেয়েদের শর্টস পরিধান করিয়া ঘুরে বেড়াইবার দৃশ্য এদেশে এখনও বিরল। তাই ইহার বিষয়ে এখনও কথা উঠে নাই।

৫.
রাস্তায় কী এ দৃশ্য এখন অনেক দেখিতে পাওয়া যায় না যে, পুরুষটি টাইট জিন্স ও ফিট শার্ট বা টি-শার্ট পরিধান করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। আর তাহার সাথে নারীটি হিজাব/বোরকা পরিধান করিয়াছে। বন্ধের দিন সকালে এই ঢাকা শহরে সুপার মলে গেলে দেখা যাইবে অনেক পুরুষসঙ্গী শর্টস ও টিশার্ট পরিয়া কেনাকাটা করিতেছেন, অার নারীসঙ্গী হিজাব-বোরকা বা সালোয়ার-কামিজ পরিয়া আছেন। পুরুষরা ফুটবল-ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, হ্যান্ডবল খেলিবার সময় হাফপ্যান্ট বা শর্টস পরিয়া অংশগ্রহণ করিতেছেন। কিন্তু একই খেলায় মেয়েরা অংশ নিলে তাহাদেরকে ট্রাউজার পরিধান করিতে হইবে। নতুবা পর্দা চলিয়া যাইবে, শালীনতা থাকিবে না। সরকারি অনুষ্ঠানে পুরুষরা স্যুট-টাই-কোর্ট পরিবেন, কিন্তু নারীরা শাড়ি পরিবেন।

পোশাকের ক্ষেত্রে সকল নিয়মনীতি নারীদের জন্য তৈরি হইয়াছে। নারীকে তার বিবাহের চিহ্ন শরীরে রাখিতে হইবে। প্রযোজনে এ জন্য নারী হাতে শাঁখা পরিবেন-মাথায় সিদুঁর দিবেন; সকল ধর্মের নারীরা নাকে নাকফুল পরিবে। কিন্তু পুরুষের শরীরে বিবাহের কোনো চিহ্ন থাকিবার প্রয়োজন নাই। পুরুষসঙ্গী মারা গেলে নারী সাদা পরিধেয় বা বস্ত্র পরিবেন। কিন্তু নারীসঙ্গী মারা গেলে পুরুষটি রঙিন পোশাক পরিলে তাহাতে তাহার স্ত্রীবিয়োগজনিত শোকের কোনো ঘাটতি বোঝাইবে না।

৬.
এ এক অদ্ভুত রকমের দ্বিচারিতা। পুরুষ নিজে পাশ্চাত্যের পোশাক পরিবেন, দুনিয়ার পুরুষীয় হাল ফ্যাশনের অংশীদার হইবেন। দেশের বাইরের বিষয়গুলো গ্রহণ করিবেন। ইহাতে ‘গেল গেল’ কোনো রব নাই, উঠিবেও না কখনও। ইহাতে সংস্কৃতির বা ধর্মচর্চার ধস নামিয়াছে বলিয়া কোনো সমাজে কোনো আওয়াজ নাই, আকুলতাও নাই। শুধু নারীর বেলায় আসিলেই বাঙালিত্ব, ধর্ম, পর্দা, শালীনতার প্রশ্ন সামনে আসিয়া হাজির হইবে। তখন শাড়ি না পরিলে নারীর দোষ। আবার কিছু বয়ানে শাড়ি পরিলেও নারীর দোষ। ইহা নাকি ধর্মীয় শরিয়া উপযোগী নয়। কেন নয়, কারণ শাড়ি পরার পর নিচের অংশ ভূত্বকের দিকে ফাঁকা থাকে। কিন্তু ইহা তো লুঙ্গির বেলায়ও খাটে। কিন্তু লুঙ্গি ধর্মের শরিয়া উপযোগী। কারণ ইহা পুরুষ পরে। নারী হিজাব না পরিলে দোষ। নারী শরীর না ঢাকিলে দোষ (কিন্তু বহু পুরুষকে দেখা যায় উন্মুক্ত বক্ষে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে অবিচলভাবে)। নারী মাথায় কাপড় না দিলে দোষ। আরও কতো কী?

৭.
আসলে সংস্কৃতি, ধর্ম, জাতিত্ব ইত্যাদি রক্ষার নামে নারীর ওপর এসব বিষয়গুলো চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং পরিবারে-সমাজে-রাষ্ট্রে এর যথার্থতা তৈরি করা হয়। আবার অনেক সময় এই কথা বেশ যুক্তির সাথে বলা হয়– শাড়ি-হিজাব-বোরকা পরার এবং অন্যান্য চিহ্ন-এর ব্যবহার ইত্যাদি হইলো নারীর পছন্দের বিষয়। ইহা সে পছন্দ করিয়া পরে। প্রত্যেকের ব্যক্তিস্বাধীনতা রহিয়াছে তার পরিধেয়-অলঙ্কার ও চিহ্ন পছন্দ করিবার। ইহাতে দ্বিমত করার কিছু থাকিত না, যদি পছন্দ তৈরির পেছনের সামাজিক তথা পুরুষতান্ত্রিক প্রয়াসটি না থাকিত।

আবার শাড়ি-হিজাব-বোরকা এবং অন্যান্য চিহ্ন-এর ব্যবহারে নারীর পছন্দের বিষয়টি সামনে আনা হইলে, ইহাও কেন সামনে আসিবে না যে– নারীর তো তাহা হইলে ব্যক্তি স্বাধীনতা রহিয়াছে শাড়ি না পরার, হিজাব-বোরকা না পরার, বিবাহের পর শাঁখা না পরার, মাথায় সিদুঁর না দেয়ার। তাহার স্বাধীনতা আছে– প্যান্ট-শার্ট-টিশার্ট-সালোয়ার-কামিজ পরিধান করিবার, খেলার সময়ে খেলাধুলার উপযোগী পোশাক পরার। বিয়ের চিহ্ন শরীরে ধারণ না করিবার। জীবন সঙ্গীর মৃত্যুর পর রঙিন বস্ত্র পরিধান করিবার। কিন্তু তা হইবে না। নারীর পছন্দ বা স্বাধীনতা শুধু প্রথম অংশে অর্থাৎ শাড়ি-হিজাব-বোরকা পরার এবং অন্যান্য চিহ্ন-এর ব্যবহারে সীমাবদ্ধ থাকিবে।

আবার ইহাহ কখনও শোনা যায় ,যাহাকে যে পোশাকে মানায়, তাহাকে সেই পোশাক পরিধান করা উচিত। নারীকে শাড়িতে মানায়, তাই নারীকে শাড়ি পরা উচিত। তাহলে কি পুরুষকে পায়জামা/ধুতি/লুঙ্গি-পাঞ্জাবিতে মানায় না? এ কারণেই পুরুষরা প্যান্ট-শার্ট পরিধান করে। তাহলে ঈদে-পূজায়, নববর্ষে অনেক অর্থ ব্যয় করিয়া পুরুষরা কেন পাঞ্জবি ক্রয় করেন?

৮.
আপাত দৃষ্টিতে নারীর পছন্দের, নারীকে মানানোর, সংস্কৃতির রক্ষার যে সামাজিক দর্শনের বা চিন্তার বক্স আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়, তাহার বাইরেও আরও কথা আছে। ইহা না বলিলে সম্পূর্ণ যে বলা হইবে না। যখন নারীর বিশেষ পরিধেয়-আবরণের-চিহ্নের সাথে ‘ভালো নারীর’, ‘সুন্দর নারীর’,‘ধার্মিক নারীর’, ‘বাঙালি নারীর’, ‘শালীন নারীর’ ‘সতি-সাবিত্রী নারীর’ ইমেজ বা প্রতিকৃতি সমাজ তৈরি করিয়া দেয়, তা শ্রেয় এবং অত্যাবশ্যকীয় বলিয়া অভিধা বা রায় দিয়া দেয়, এবং নারীকে তা গ্রহণে উৎসাহিত-উদ্দীপ্ত-প্ররোচিত করা হয়, তখন নারীর পক্ষে তা গ্রহণ এক ধরনের ‘পছন্দের’ আপেক্ষিক ফলাফল তো বটেই। ইহার সাথে অাছে নারীর উপর হুমকি-ভয়-ধমক-অনুশাসন। নারী এসব না মানিয়া যাইবে কোথায়?

৯.
আসলে সমাজে সংস্কৃতির নামে, জাতীয়তার নামে, ধর্মের নামে, প্রথার নামে এসব হইলো নারীর ওপর বিশেষভাবে ড্রেসকোড আরোপ করা। তাকে গ্রহণীয় করে তোলা এবং যথার্থতা দেওয়া। যার লক্ষ্য হইলো নারীর শরীর, নারীর যৌনতা, নারীর প্রজনন তথা নারীর জীবনকে অধীন করা, অধীনে রাখা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের ইহা একটি কূটকৌশল মাত্র, কীভাবে নারীর সচলতা, স্বাধীনতা, অধিকার হরণ করা হইবে, কীভাবে নারীকে অবরোধে রাখিতে হইবে কিংবা রাখা হইবে, এবং নারীকে পুরুষের শর্তাধীন, অধীন ও অধঃস্তন রাখিবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.