আয়শা আকতার কণা: শেফালী- আমার বাসা, আমার মা এর বাসার এক ধরনের ম্যানেজার সেই। অসম্ভব দক্ষতার সাথে সে কাজ করে যায়। ছিপছিপে গড়নের প্রায় পাঁচ ফিট তিন ইঞ্চির অসম্ভব সুন্দর আর সুবেশি স্মার্ট এক মা। পোশাক-আশাকে কেয়ারলেস তাকে আমি খুব অবাক হয়ে দেখতাম। আর দেখতাম মা দুর্গার মতো দুই বাসার কাজ সেরে নিজ বাসার সব কাজ, সন্তানের পড়াশোনা এবং অন্যদের দায়িত্বকে কাঁধে নিয়েও হাসিখুশি মুখের সেই তাকে।
এবার এসে পেলাম এই দারুণ স্মার্ট শেফালীকে হিজাব আবৃত অবস্থায়। শুরুতেই বলে নিচ্ছি, অন্য অনেকের মতো প্রগতিশীলতা মাপতে হিজাব ইনডিকেটর হলেও, আমার জন্য তা নয়।
কিন্তু কী এমন হলো যা ওকে এই পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করলো তা জানার জন্য কিছু কথা বললাম। শুনে কেমন যেন এক শংকায় আচ্ছন্ন হলাম। আমাদের কথোপকথনে যা ছিল তা অনেকটা এ রকম:
আপু, আমি এখন তালিমে যাই তো, ওনারাই বলেছেন পর্দা করতে। আপনাদের মতোন এক আপা সপ্তাহে সপ্তাহে আসেন। যেকোনো একজনের বাসায় আমরা অনেকেই বসি। এতো ভালো কথা বলে যে এ ক’দিনেই অনেক মানুষ বেড়েছে। বসার জায়গাও পাই না আগে না গেলে। আপু, ওইখানে যেতে আমার এখন খুব ভালো লাগে। আমি একটা বাসার কাজ ছেড়ে দিছি সময়ের অভাবে। কাজের চেয়ে ভালো কথা শোনা জরুরি।
আমি চুপ করে ওর কথা শুনে যাচ্ছিলাম। মনটা বিষন্ন। ওকে আমার টাইম দিয়ে বুঝিয়ে কথা বলা দরকার। কিন্তু আমি সো-কল্ড তা করবো না। শুধু আহা-উহু, গেলো-গেলো, আর ২/৪টা স্ট্যাটাস, এইটুকুই…।
শেফালীরা বদলে যাচ্ছে। এই শেফালীদের কেউ কেউ আজ সেই আত্মঘাতী মা হয়ে যাচ্ছে কী না, কে জানে!
হচ্ছে, আর তা আমাদের জানিয়েই…।
একবার একটু ইনিয়ে-বিনিয়ে বললাম শুধু, তুমি কি এমন নতুন কথা জেনেছো সেখানে যা তোমার মাবাবা কখনোই বলেনি! তারাতো তোমাকে পর্দা মানে ভালোভাবে চলতেই বলতো, নামাজ-রোজা করতেও বলেছে, মিথ্যা বা চুরি করতেও বলেনি। ভালো মেয়ে হবার জন্য নিশ্চয় অনেক কিছুই শিখিয়েছিল। তাই তুমি একটু আলাদাও ছিলে কিন্তু। এবং তোমাকে দেখে আমার অনেক হিংসা হতো! ভাবতাম, কিভাবে তুমি এতো অভাব কষ্টেও এত সৎ!
এত স্মার্টলি কাজ করে দশ দিক আগলাচ্ছো! ইভেন ফিগার আর সুন্দর সব ড্রেস কিভাবে মেইনটেইন করছো!
বললো, না আপু। উনি অনেক আলাদা, আপনের চেয়েও বেশী লাগে তারে। এভাবে আমার মা-বাবাও বলতো না।
বাইরে বের হবার তাড়া থাকায় যথারীতি হাল ছাড়লেও শেষ চেষ্টা হিসেবে বললাম, এতো নিয়মিত হয়ো না,
আর অন্য কোনো ধর্মের বা চেহারার মানুষকে দেখে যদি কোনোদিন ঘৃণা লাগা শুরু করে আমাকে তখনই ব’লো…এমনিই ব’লো।
আমরা সেদিন কথা না বললে তুমি হয়তো আমাকেও আর পছন্দ করবে না আর!
এবার শেফালী চুপ।
আস্তে আস্তে বলে উঠলো, আমাকে যে যাই বোঝাক আমি তা সব শুনি না। একা একা অনেক ভাবি। ঠিক মনে হলে আমি ঠিক সেটাই করি।
শেফালীর কাছে ঐ মুহূর্তে কে যে ঠিক, তা মুখ দেখে ঠাহর করতে পারলাম না কোনোভাবেই।
আমি!
ওর বাবা-মা!
নাকি সেই আমাদের মত দেখতে মানুষটি!
পাথর চোখে কোনো ভাষা থাকেনা বলে পড়তেও পারিনি!
মাথায় ঘুরছে সেই থেকে। এই ‘ওরা’ আজ দূর থেকে ঘরে। কেন যে বস্তি থেকে পাড়া, মহল্লা বা উচ্চবিত্তের ড্রইংরুম পর্যন্ত যাচ্ছে, কী যে চায় আর এর প্রয়োজনটাই বা কতখানি তা এই মাথা আজো বুঝে উঠতে পারে না কোনোভাবেই !
বাবা-মা এর দায়িত্ব আজ আপনি মোড়লদের! কে দিলো তাদের এত পাওয়ার!
কাদের এত টাকা যাতে রুট পর্যন্ত এই এক্টিভিটি চালিয়ে যাওয়ার এবং এত দক্ষ মানুষদের হায়ার করার!
বললে তো হযবরল এর বেড়ালের মতো বলবেন, ‘তাও জানো না, এতো বোঝাই যাচ্ছে! বলে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে হাসবেনও হয়তো বা।
আর তারপর সবাই চুপ করেই থাকবো!
জানলে, বা বুঝলে কেউ চুপ থাকতে পারে কি!
না, আমরা জানি না। প্রলয়ের চেহারা ভেবে নিলেও নিজের উপর না আসা পর্যন্ত জানিইনা…
এটাই সত্য!
জানি না বলেই এমন নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে প্রলয় না দেখার চেষ্টা করে যাই, আজও।