ধর্ম যার যার, মানবতা আমার!

বনাঙ্কুর মুস্তাফা: অনেক দিন পর লিখতে বসলাম। এর মাঝে অনেক কিছু ঘটে গেছে। পূজা নির্মমভাবে ধর্ষণের শিকার হয়ে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে আমরা আর নিজেদের আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব বলার যোগ্যতা রাখি না।

সাঁওতালরা বাস্তুহারা হয়েছে, মন্দিরে পূজায় হামলা করে মূর্তি ভাঙ্গা হয়েছে…আর আমাদের মাননীয় দেশরক্ষকরা প্রমাণ করছেন যে রাজনীতির সাথে তারা মানবনীতিকে মেশাতে চান না!

বনাঙ্কুর মুস্তাফা

এই সবকিছুর সাথে কোন না কোনভাবে ধর্ম জড়িত বা ধর্মকে জড়ানো হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা ধর্ম, বর্ণ, মেল শভিনিজম, আর উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া গোঁড়ামি নিয়ে পড়ে আছি!

কানাডায় আমাদের প্রাইম মিনিস্টার জাস্টিন ট্রুডো বিশ্বজুড়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন তাঁর উদার মানসিকতা আর উন্নয়ন কার্যক্রম এর কারণে। তিনি একজন ক্রিশ্চিয়ান; কিন্তু তিনি দিব্যি ঈদের দিনে মুসলিমদের সাথে নামায পড়েন, পূজায় মন্দিরে যান…সব ধর্মের মানুষের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন।

অনেকে বলতে পারেন, এটা হয়তো তার পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজি! তবে যদি সেটাই হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে, এই কানাডায় সবাই পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজি ফলো করে। এতো বছর এখানে আছি, আমি কখনও কোন ক্রিশ্চিয়ান/হিন্দু/বৌদ্ধের ধর্মীয় গোঁড়ামি বা রোষানোলের শিকার হইনি। বরং অনেক বাঙালি মুসলিমদের দেখেছি, তারা গোঁড়ামি পোষণ করেন এবং তার প্রেক্ষিতে বিরুপ আচরণ করেন।

(আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। কিন্তু তিনি কি পারেন না, তাদের সাথে তাদের মাঝে উপস্থিত হয়ে তাদের আনন্দ ভাগ করে নিতে, তাদের উৎসবে সরাসরি শরীক হতে!)

ঠিক কবে, কখন, কিভাবে, আমাদের সহজ-সরল-ভালবাসার ধারক জাতিটি এমন নিষ্ঠুর আর বিদ্বেষ-পরায়ণ হয়ে উঠলো? যে জাতির স্বাধীনতার জন্য ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে লক্ষ্য মানুষ শহীদ হয়েছিল। এ্যান্ড, ডিড নট উই ফাইট এগেইন্সট দ্য মুসলিমস অফ পাকিস্তান?

সেই নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ থেকে কী আমরা শিক্ষা পাইনি যে ধর্ম মানুষের চরিত্র, মানবিকতাকে নির্ধারণ করে না? পৃ্থিবীর কোনো ধর্মেই মানুষকে খারাপ হতে, চুরি করতে, হত্যাকাণ্ড চালাতে, ঘৃণা ছড়াতে বলা হয়নি।

ইরাক, ইরান, সিরিয়া, আফগানিস্তানে যখন নিরীহ মুসলিমরা মারা যায়, তখন আমাদের যেমন খারাপ লাগে, বাংলাদেশের ‘সংখ্যালঘু’ হিন্দুদের উপর অত্যাচার চালালে তো সারা বিশ্বের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একইভাবে খারাপ লাগে। আমরা কেন বার বার ভুলে যাই, ধর্ম যাই হোক, প্রথমত আমরা মানুষ?

মাত্র ক্রিস্টমাস পার হলো। নর্থ আমেরিকাতে থাকার সুবাদে এই দিনটা বেশ আনুষ্ঠানিক্তার সাথেই পালন করা হয়। অফিশিয়াল ক্রিস্টমাস ডিনার, গিফট এক্সচেঞ্জ, ক্রিস্টমাস মার্কেটে লাইটস দেখতে যাওয়া… তবে আমার আশেপাশে অনেককে প্রায় বলতে শুনি, সাদারা আমাদের ‘মেরি ক্রিস্টমাস’ বললে আমাদের হ্যাপি হলিডেইজ বলা উচিত, কারণ মেরি ক্রিস্টমাস বললে পরে আমরা ‘বিধর্মী’ হয়ে যেতে পারি!

একবার গুগল করলেই দেখবেন ‘মেরি ক্রিস্টমাস’ মানে হলো জিসাস ক্রাইস্ট এর জন্মদিনকে ‘মেরি’ অর্থাৎ আনন্দময় করে তোলা। (Christians believe that the 25th of December is the birth date of Jesus Christ, hence Christmas day, etc. There is an expression, ‘To make Merry‘, which means to be joyful, celebrate, and be in general good cheer. Merry Christmas implies that people should Make Merry and enjoy in the celebration of his birth.)

কিছুদিন আগে ফেসবুকে দেখলাম, জেরুসালেম এর একজন আর্চবিশপ এর উদ্ধৃতি দিয়ে একটি পোস্ট। তিনি বলছেন, তিনি একজন প্যালেস্টিনিইয়ান ক্রিশ্চিয়ান; তার মতো আরো অনেকেই সেখানে আল্লাহু আকবার, ইনশাআল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ বলে থাকেন কারণ তাদের ভাষা হলো আরবি এবং আরবিতে গড এর নাম হলো আল্লাহ্!

এখানে যেমন কেউ হাঁচি দিলে বলে, গড ব্লেস ইউআরবিতে আমরা বলি, ইয়ার হামুক-আল্লাহ, অর্থাৎ মে আল্লাহ হ্যাভ মারসি অন ইউ। ঘুরে ফিরে আমরা কিন্তু একই কথাই বলছি! তাহলে আমাদের কাজে, আমাদের ব্যবহারে, আমাদের অন্তরে কেন মিল থাকবে না?

আমরা যদি এতোটাই আমাদের ধর্মকে সবখানে প্রাধান্য দিতে চাই, তাহলে কেন দিন-তারিখের হিসাবটা হিজরিতে গণনা না করে ক্রিশ্চিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী করি?

আমার পরিবারে যারা কিনা বেশ ধর্মীয়পন্থী, তাদের কাউকে যদি জিজ্ঞেস করি, আজকের তারিখটা কত, আমি নিশ্চিত তারা কেউ বলবেন না, আজ ২৭শে রবিউল আউয়াল, বলবেন, আজ ২৮ ডিসেম্বর! তার মানে কী তারা প্রকৃ্ত মুসলিম না!

এখানে বলে রাখতে চাই, আমি মুসলিম এবং ইসলাম ধর্ম অনুসারী; আমি নামায পড়ি, রোযা রাখি, তবে আমি মনে প্রাণে ধর্মনিরপেক্ষ। আমি বিশ্বাস করি, আমরা সবাই একজন ঈশ্বরের সৃষ্টি। আমাদের প্রার্থনার ভঙ্গি হয়তো আলাদা, ভাষা হতে পারে ভিন্ন…

যেমনটি বলছিলাম, আমার জানা মতে ইসলাম বা অন্য কোন ধর্মে কোথাও এটি বলা নেই যে, অন্য ধর্মের মানুষদের ঘৃণা করতে হবে বা তাদের বিনাশ করতে হবে

বিশেষত বাংলাদেশের মতো জায়গায় যা কিনা ১৩০০ সালের আগ পর্যন্ত বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্ম দ্বারা অধ্যুষিত ছিল! কে জানে, আমার চৌদ্দ পুরুষ আগে হয়তো আমার পরিবার হিন্দুই ছিল (জেনারেশান বোঝাতে কেন ‘পুরুষ’ শব্দটা ব্যবহার করা হয় সেটাও একটা যুক্তিতর্কের বিষয়, তবে সেটি আরেক দিন)! সে অবস্থার যদি পরিবর্তন না হতো, তাহলে হয়তো আজ আমি মাথায় সিঁদুর পরে মন্দিরে পূজো করতে যেতাম! তারপর কী, একদিন আমাকে একদল তাথাকথিত ধর্মরক্ষক এসে ধর্ষণ করে চলে যেতো? অথবা আমার সংখ্যালঘু পরিবারটিকে বাস্তুচ্যূত করতো?

আমাদের সংবিধানেও বলা আছে, বাংলাদেশ একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রআমরা নিরপেক্ষ শব্দটার অর্থ জানি? আমি অনেক সময় আমার মাকেও বলতে শুনেছি, এবং আমি জানি তিনি এটি নিজের অজান্তেই করেন, কারণ তাঁর আশেপাশে তিনি এমন দেখেই অভ্যস্ত, “ওই যে, বর্ণার সাথে একটা বৌদ্ধ মেয়ে পড়তো না?…ওর বিয়ে…” কবে কখন থেকে ধর্ম এভাবে আমাদের পরচয় নির্ধারক হয়ে উঠলো? কেন এই ধরনের ক্যাটাগরাইজেশান?

বলি ধর্ম কী এতোই সস্তা হয়ে গেছে যে তাকে ‘উজ্জীবিত’ করার জন্য অন্য ধর্মের উপর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে হবে? কিছুদিন আগে নাদিয়া ইসলাম লিখেছিলেন যে, আমরা অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টি যদি বড় হই, তাহলে আমাদের সৃষ্টিকর্তাও বড় হন। আর আমরা বড় হই কিভাবে? আমাদের সুকর্মের মধ্য দিয়ে, তাই তো? আর যদি আমাদের আচরণে আমরা পশুর সমতুল্য হয়ে যাই, তাহলে আর ধর্ম থেকে লাভ কী? গরু-ছাগলের তো আর ধর্ম নেই!

আসুন, আমরা বিচার করি, আমরা কি মানুষ…না কি কালে কালে আজ পশুতে পরিণত হয়েছি…?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.