লিলিয়ান: পৃথিবীতে সবচে কোন মানবিক সম্পর্ককে ঘেন্না করি?- জানতে চাইলো একজন। এক মুহূর্ত না ভেবে উত্তর দিলাম- প্রণয়ই নেই, অথচ প্রণয়ের আবরণে থাকে যে সম্পর্ক… মানে?
কিছু না…
রেজিগনেশন লেটার দিয়ে বের হবার আগে এই শেষ কথোপকথন ছিল এই ‘তার’ সাথে আমার। তার ‘চোখের ভাষায়’ কিছু একটা ছিল। আর কিছু একটা ছিল আমার ‘হৃদয়ে’… ।
অফিসে জয়েন করার তিন মাসের মধ্যে বুঝে ফেললাম ভয়ংকর এক ঘটনা ঘটে গেছে!
আমি প্রেমে পড়েছি! কলেজ, ইউনিতে যে মেয়ে প্রেমে পড়লো না, সে কিনা অফিসে জয়েনের তিন মাসের মধ্যে ঠিক তার এক ধাপ আগের র্যাঙ্কের একজনের প্রেমে পড়ে গেল?? দুজন দুজনকে যে ভয়াবহভাবে চাচ্ছি তা আমরা দুজনই বুঝতে পারছিলাম।
কেউ কিন্তু কাউকে কিছু বলিনি, জানাইনি। কাজের সূত্রে একসাথে চলার কারণে ক্ষণে-ক্ষণেই উপলব্ধি করছিলাম, ‘আরে এই তো সেই ব্যক্তি, যার জন্য এতোদিনের অপেক্ষা আমার!!!’ উনিও জানাচ্ছিলেন এমন সব পছন্দ-অপছন্দের কথা, যার ইঙ্গিত ঘুরে ফিরে আমার দিকেই আসতো। আমার মানবিক বৃত্তের পরিসীমাতেই যা খাপে খাপ মিলে যেত।

একটুও উনিশ-বিশ হতো না। এতো মিল কিভাবে সম্ভব?? ভাবতে ভাবতেই মনে আসতো ধাক্কা!! কেননা সে যে বিবাহিত!!
কিন্তু তিনিই জানিয়েছেন, স্ত্রীর সাথে তার কিছুতেই মিল হয় না, অথচ পছন্দেই বিয়ে করেছে তাকে। স্ত্রী নাকি তাকে সহ্যই করতে পারে না!! সব সময় রেগে থাকে, খারাপ ব্যবহার করে। বোঝার চেষ্টা করতাম, এতো পরিচ্ছন্ন একজন ব্যক্তি, যার সবকিছুতে কেবল কেউ মুগ্ধই হতে পারে, তার সাথে স্ত্রীর কেন বনিবনা হবে না। এতো লজিক্যালি যিনি ভাবতে পারেন, যার ভাবনায় বিমোহিত হই, নিউরনে শিহরণ জাগে যার সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতির জ্ঞানগর্ভ আলাপে, তাকে কিভাবে তার স্ত্রী বোঝে না?? এতো সুন্দর মনের একজন মানুষ, এতো পবিত্রতা যে ধারণ করে, তাকে কিভাবে তার স্ত্রী ভালো না বেসে পারে?
একটুকু ছোঁয়া লাগে,
আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন,
আমি তোমারও সঙ্গে বেঁধেছি আমারও প্রাণ, সুরেরও বাঁধনে …
এসব গান যে অবিরত গুন গুন করে, তার প্রতি একজন স্ত্রী কিভাবে রেগে থাকে??
এক বর্ষণ মুখর রাতে যার ভরাট কণ্ঠে প্রিয় কবিতা ‘আমি বলছি না আমাকে ভালবাসতেই হবে’ শুনে শিহরিত হয়েছিলাম, আবেগে আপ্লুত হয়ে সারা রাত ঘুমুতেই পারিনি, সে কিনা নিজের স্ত্রীর ব্যাপারে এতো উদাসীন! স্ত্রী আলাদা রুমে থাকে, বিশাল ফ্ল্যাটের এক কোনায় সে থাকে বইয়ের সমুদ্রে ডুবে! এতো বৈপরিত্ব্যে খটকা লাগতো… কিন্তু মোহগ্রস্ত যে থাকে, সে কি পরিষ্কার চিন্তা করতে পারে??
পারে না। নতুন জয়েন করাতে উনার সবকিছুই ঘোরের মতো লাগতো। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হতো। এরই মাঝে সে জানালো, তার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। ফেসবুকেও এমন কথায় তার গুণমুগ্ধরা পাঁচশ’র বেশি মন্তব্য করে ফেললো।
আর আমি শুধু দেখি আর দেখি। এতো কষ্ট কি আমাকে না পাওয়ার জন্য? বাঁচার ইচ্ছাহীনতা কী কেবল আমি তার জীবনে নেই বলে?? কাঁদতে কাঁদতে রাত পার হয়…এভাবেই আট মাস চলে গেল।
এরই মাঝে বদলি হয়ে এলেন নতুন এক সিনিয়র… ধরে নেই উনার নাম তাহমিনা। এসেই আমাকে খুব স্নেহ মাখা আদরে কাছে টেনে নিলেন।
উনার সবকিছুই ভাল লাগতো, শুধু ভাল লাগতো না যার প্রেমে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি তার ব্যাপারে নেতিবাচক আচরণ। এবং তাহমিনা আপা রাখ-ঢাক না করেই তা করতেন। কষ্ট পেতাম। খুব বেশি কষ্ট। একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেললাম ‘আচ্ছা এমন করেন কেন উনার সাথে?’ শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভুল করছো…’।
ভেতরে ভয়াবহ ধাক্কা খেলাম, একজন অসুখী লোক যে স্ত্রীকে দিয়ে মোটেও সুখী না, যে প্রতিনিয়ত বলে ডিভোর্স দেবে মনের মতো কাউকে পেলে, এবং সবচে বড় কথা, যার সাথে মানসিকভাবে আমার সবকিছু মিলে যায়, অন্তত: সে তো তাই আচরণে বুঝিয়েছে, সে যদি আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায়, তাহলে তা ‘ভুল’ হবে কেন??
আমিও তো উনাকে চাই… উনার স্ত্রীকে নিয়ে আমার কোনোই আপত্তি নেই। আমার সকল নিয়ে যার জন্য সর্বনাশের আশায় বসে আছি সেই তো ইনি। না হয় ভুল করে বিয়ে হয়েই গেছে। তাতে কী? উনিও তো এমনই চান, তাই আভাসে বুঝিয়েছেন!
মনে মনে এসব ভেবেই তাহমিনা আপার ‘ভুল করছো’ কে উড়িয়ে দিলাম। কিন্তু ভীষণ বোকা আমি বুঝিওনি জীবনের ভয়াবহ অসুন্দর রূপ দেখা অভিজ্ঞ তাহমিনা আপা ঠিকই বলেছিলেন।
এরপর এক মাস পেরিয়ে গেছে, আমরা এখন ভালোই আলাপ করি, সে আলাপ শেষও হয় ‘পবিত্র’ ভাবে। রবীন্দ্র, নজরুল, লালন, আর মাঝে মাঝেই হুমায়ুন আহমেদ এর চরিত্র বিশ্লেষণ শুনি। উনি কেন শাওনকে একসেপ্ট করেছেন, গুলতেকিনকে কেন ছেড়ে দিলেন তা শুনি, উনার বলায় থাকে শাওন হুমায়ুনকে সুখী করেছে, গুলতেকিন ভুল ছিল।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনি। যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা কথা বলছে… এরই মাঝে উনার কক্সবাজার যাবার প্ল্যান শুনছি ছুটিতে, দুই একবার আমাকেও বলেছেন যেতে, সমুদ্রের পারে রাতে হাঁটতে হাঁটতে নাকি উনি কী এক বিশেষ কথা বলবেন,
এমনভাবে বলেছিলেন, শিহরিত আমি লজ্জায় মিশে গিয়েছিলাম… তবে উনি জোর করেননি।
আমি বলেছি দেখি….। মুখ ফসকে একদিন তাহমিনা আপাকে বলে ফেললাম যে কক্সবাজার যেতে বলেছেন উনি। তাহমিনা আপার মুখ থেকে রক্ত সরে গেল, আমার রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। ৪৫ মিনিট পর এসে বললেন, ‘চলো, আজ বাইরে খাবো’।
কোনো কথা না বলে বের হয়ে এলাম। সিক্সথ সেন্স বলছে, কিছু একটা ঠিক নেই। পুনর্জন্মে আমি বিশ্বাসী নই! সেই আমিই আজ বলি, যে আমি সেদিন লাঞ্চে গিয়েছিলাম, সে আমি আর ফিরিনি। ফিরেছিল অন্য কেউ। তাহমিনা আপা জানালেন ‘তামান্না’ নামের একজনের কথা।
তামান্না আমাদের অফিসে আগে কাজ করতো। আমি এখন যে পদে, সেই পদেই ও ছিল। মেয়েটা নাকি কক্সবাজার থেকে ফিরেই অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল।
অফিস ছুটিতে উনিও ছিলেন সেই ট্যুরে। এক ট্যুরে ‘যা’ পাওয়ার জন্য উনি জাল ফেলেছিলেন, ‘তা’ দিয়ে দিয়েছিল তামান্না এবং সেই ‘তা’ পেয়ে যাবার পর উনি তামান্নাকে আর ফিরেও দেখেননি।
স্ত্রীর এসব বদনাম নাকি ডাল-ভাত উনার কাছে। স্ত্রীকে উনি কোনদিনই ডিভোর্স দেবেন না। তবে মেয়েদের সাথে এমন করে যাবেন, যার থেকে যতোটুকু নেয়া যায়, তাতেই উনি সন্তুষ্ট থাকেন। ছয় বছরে কতো মেয়ের সাথে এমন করেছেন তাহমিনা আপা নিজেও জানেন না।
একজন মেয়ে যা চায় তার সবই সৃষ্টিকর্তা উনাকে দিয়েছেন, ভরাট কণ্ঠস্বর, ক্ষুরধার জ্ঞান, সাহিত্য বিশারদ, প্রচুর বই উনার পড়া, আর সবচে বড় হাতিয়ার হলো, কে জ্ঞানের আলাপে ফাঁদে পা দেবে, আর কে সস্তা শাড়ীতে, তা উনি খুব ভালোই বুঝতে পারেন। আরও বুঝতে পারেন কে কীসে মুগ্ধ হয়! সাহিত্য, রাজনীতির আলাপে কে মরবে, আর কে হাবিবের গানের সিডিতে।
অর্থাৎ মেয়ে রিড করাতে উনি সিদ্ধহস্ত। সবকিছুই উনি করেন শিকার ধরতে, শুধু শিকারটাই তা বুঝে ওঠে না।
যখন বোঝে তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। আর সবচে বড় কথা উনি সব সময় এমন এক আবহ তৈরি করে রাখেন, যাতে মেয়েরা উনাকে ব্লেম দিতে না পারে। এমন কোনো প্রমাণ উনি রাখেন না, যাতে ‘মুখোশ’ টা বাকিরা দেখতে পায়।
তৃষ্ণার্ত প্রেমিক মুহূর্তেই হয়ে যায় চরম স্বার্থপর একজন… শুধু কক্সবাজারের একটা ট্যুর হওয়া পর্যন্তই অপেক্ষা!
লাঞ্চের শেষকালে জেনেছিলাম তামান্না পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল চাকরি ছাড়ার আগে। ফেসবুকে নাকি লম্বা লম্বা মেসেজ দিয়েছিল, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। যখন তামান্না মেসেজ দিচ্ছিল, ঠিক তখন উনি ফেসবুকেই স্ট্যাটাস দিয়েছেন আহমেদ ছফাকে নিয়ে।
বিশ্লেষণধর্মী সে লেখায় লাইক পড়েছিল, মন্তব্য পড়েছিল। উনি সেসবে লাইক-পাল্টা উত্তর সবই দিয়েছিলেন, শুধু দেননি তামান্নাকে ‘আমার সাথে কেন এমন করলেন’ এর উত্তর!
লাঞ্চ থেকে ফিরে রেজিগনেশন লেটার লিখে ফেললাম, আর তাহমিনা আপার থেকে নিলাম তামান্নার ঠিকানা।
কী সুন্দর মেয়েটা! ভোরের শিশিরও কি এতো স্নিগ্ধ হয়?- ওকে দেখে এ কথাটাই প্রথম মনে এলো!
পরিচয় দিয়ে সব খুলে বলতেই জানালাতে চোখ নিয়ে গেল। আর সে চোখ বেয়ে পড়ছে অভিমানে সিক্ত নোনা জল। মুখ ও মুখোশের পার্থক্য ধরতে পারা, আর না পারা দুইজন একই রুমে নিঃশব্দে বসেছিলাম। নিঃশব্দ শুধু ভেঙ্গে যাচ্ছিল একজনের বুক ভাঙ্গা ফোঁপানো কান্নাতে।
****এই গল্পের সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে এর কোন মিল নেই, কেউ যদি মিল খুঁজে পান তাহলে তা অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় ঘটনা মাত্র।