আমার নারীবাদের গুরু 

তামান্না ইসলাম: আমার অনেক লেখায় অনেকবার চলে এসেছে আব্বু, আমার একজন প্রিয় বন্ধু। আলাদা করে আব্বুকে নিয়ে লেখা হয়নি তেমন একটা। আজ লিখতে ইচ্ছা হলো। 
কিছুদিন আগে আমরা কয়েকজন মেয়ে মিলে আলোচনা করছিলাম টেকনিক্যাল ফিমেলদেরকে কীভাবে আরও সুযোগ করে দেওয়া যায়, আমাদের  নিজের কোম্পানিতে এবং আশে-পাশের  স্কুল-কলেজে, ইউনিভার্সিটির ছাত্রীদেরকে। ওই গ্রুপের বর্তমান লিডার কথায় কথায় বলছিল, ‘আমি যে আজ এখানে তার এটা বড় কারণ আমার বাবা আমাকে দুই বছর বয়স থেকে বলেছে, আমি যা ইচ্ছা তাই হতে পারি।’  
আমি এই ধরনের গ্রুপে যতবার আলোচনায় বসেছি, একটা ব্যাপারে আমরা সবাই একমত হই যে আমরা টিপিক্যাল মেয়েলি চিন্তা করতে পারি না, আমাদের চিন্তা কিছুটা ভিন্ন খাতে চলে। তার মানে এই না যে আমরা সাজি না, রান্না করি না, ঘর গুছাই না, আমাদের বাচ্চা বা সংসারের দেখাশোনা করতে হয় না, বা এই ভাবনাগুলো আমাদের নেই। এই সবকিছুর সাথে আমাদের সত্ত্বার একটা বিশাল অংশ হলো, আমরা মানুষ, আমাদের আলাদা অস্তিত্ব আছে, সেই অস্তিত্বকে আমরা কোন কিছুর বিনিময়েই ছোট হতে দেব না। আমাদের চিন্তা, স্বপ্ন খালি বাচ্চা বা স্বামী -সংসার ঘিরে না, আমাদের  নিজেদেরকে নিয়ে স্বপ্ন আছে, পৃথিবীকে নিয়ে স্বপ্ন আছে, সেই স্বপ্ন দেখা কেউ থামাতে পারবে না। 
আমি অনেক ভেবে দেখেছি, অনেক ছোটবেলা থেকেই  আমি যে টের পেতাম অন্য দশটা মেয়ের চেয়ে আমি একটু আলাদা ভাবে ভাবি (ছোটবেলায় এই ভাবনাটা  খুব কষ্টের ছিল যদিও), এর কারণ কী। এর অবশ্যই একটা বড় কারণ আমার চাকরিজীবী স্বাধীনচেতা মা। আমার চোখের সামনে দেখা জাজ্বল্যমান রোল মডেল। তাঁর কারণেই হয়তো আমি সাজগোজ, পর চর্চা, অতিরিক্ত কৌতূহল নিয়ে বেশিক্ষণ মেতে থাকতে পারি না, মাথায় ঘুরে প্রডাক্টিভ কিছু করতে হবে, সময় নষ্ট করা যাবে না। আমার বান্ধবীরা যখন হিন্দি সিনেমা, বা ফ্যাশন বা ছেলেদের নিয়ে গল্প করতো, আমি একটু পরে হাঁপিয়ে যেতাম, অন্য বন্ধু খুঁজতাম যার সাথে বই নিয়ে, গান নিয়ে কথা বলা যায়, এমনকি অল্প বয়সের নিছক ছেলেমানুষি ফিলসফি, জীবন দর্শন নিয়ে কথা বলা যায়। 
তবে আরও একটা অনেক বড় কারণ আমার বাবা।  আমার বাবা কোনদিন আমাকে মেয়ে বলে আমার ছোট দুই ভাইয়ের চেয়ে কোন অংশেই ছোট করে দেখেনি।  নিউ মার্কেট থেকে শুরু করে লালবাগের নোংরা, দুর্গন্ধ কাঁচাবাজারেও আমি আমার বাবার সাথে বাজার করতে গেছি। পুরানো ঢাকার অলিগলি, সদরঘাট কিছুই বাদ যায় নাই। গরুর হাটে গরু কিনতে গেছি। ছুটির দিনে দুপুরে খেতে বসে নিজের প্লেট থেকে মাছের মাথাটা তিনি আমার প্লেটে তুলে দিতেন। এইসব ছোট ছোট কাজের মধ্য দিয়ে তিনি আমাকে শিখিয়েছেন, সংসারে মেয়ের আদর কম নয়, বরং বেশি। মেয়েরা পারে না এমন কোন কাজ নাই। 
সংসারে ছেলেদের কাজ আর মেয়েদের কাজ বলে নির্দ্দিষ্ট কিছু আছে, আমি সেটা দেখে বড় হই নাই। আমাদের বাসায় আমি নিয়মিত দেখতাম ভারী কাপড়গুলো আব্বু ধুয়ে দিত। আম্মু সূতির শাড়ি পরে কলেজ করে। কড়া মাড় দেওয়া, ইস্ত্রি করা শাড়ি হতে হবে। আব্বু দুই এক সপ্তাহ পরপর পাইল করা পাঁচ-ছয়টা শাড়ি ইস্ত্রি করে দিত। আমরা পর পর তিন ভাইবোন। আম্মু চাকরি করে, বাসায় নিত্য মেহমান। টানাটানির সংসার। আমাদের সাথে খেলা, গল্প করার দায়িত্ব আব্বুর। খুব ছোটবেলায় আম্মু হয়তো রান্না করছে, আব্বু আমাদের সাথে লুডু, দাবা এই সব খেলছে। একটা বড় কারণ অবশ্য আব্বু বাচ্চাদেরকে পছন্দও করতেন।
আরও বড় হওয়ার  পরে আমাদেরকে পড়ানোর দায়িত্ব দুই জন ভাগ করে নিয়েছেন। আব্বু আমাকে স্কুলে নামাতেন, ভাইদের চিন্তা আম্মুর। রান্না-বান্না  সম্পর্কেও তাঁর অনেক আগ্রহ এবং জ্ঞান। আমার মন মানসিকতায় তাই স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব সম্পর্কে যে সুস্পষ্ট ধারনাটা ছিল, সেটা আমি অনেক আধুনিক বাঙ্গালি সংসারেও দেখি না। আমি চাকরী করবো আমার স্বামীর সাথে সমান তালে, এটা আমার কাছে আমার প্রাপ্য অধিকার, কোন বাড়তি সুযোগ নয়, সেটা আমার বাবাই আমাকে শিখিয়েছেন তাঁর জীবন  দিয়ে। সংসারের প্রতি আর্থিক দায়িত্ব স্বামী, স্ত্রীর সমান সমান, ঠিক তেমনি সংসারের বাকি দায়িত্বও তাদের দুজনেই সমানভাবে নিতে হবে, এটাও আমার বাবার কাছেই শেখা। 
তবে আব্বুর যেই ব্যাপারটা আমাকে আজও মুগ্ধ করে, আর এই গুণটা আমার অনেক বিরল মনে হয়, সেটা হোল স্ত্রীকে অনেক বেশি শ্রদ্ধা করা। আমার মা ছেলেদের সাথে সমান তালে কাজ করেছেন, আব্বুর পূর্ণ সমর্থন তো ছিলই, অনেক ক্ষেত্রে তিনি সাধ্যমতো সাহায্য করেছেন।
প্রফেশনাল কাজে তিনি আমার মাকে নিজের চেয়ে দক্ষ মনে করেন এবং খোলা মনে সেটা শুধু স্বীকারই করেন না, সেটা নিয়ে তিনি গর্বিত। স্ত্রীর দক্ষতায় গর্বিত স্বামী আমি কয়জন দেখেছি আমার মনে পড়ে না। সংসারের যেকোনো ছোট-বড় সিদ্ধান্তে তিনি আম্মুর মতামত নিয়েছেন, হয়তো সব সময় মতের মিল হয় না, তবুও। তাদের একজনের অগোচরে আরেকজন কখনোই কোন সিদ্ধান্ত নেননি। এখনো আমাদের ভাইবোনদের চাকরি, অফিস, সন্তান যেকোনো ঝামেলায় তিনি বলবেন ‘আম্মুকে জিজ্ঞেস কর।’  
আমার নারীবাদী মনের হাতে খড়ি আসলে আমার শৈশবে, আমার আব্বুর কাছে। তিনি আমাকে দেখিয়েছেন কীভাবে একজন মেয়েকে মানুষ হিসাবে মূল্যায়ন করতে হয়, তাঁর এই ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো না। 
শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.