শারমীন জান্নাত ভুট্টো: সকাল থেকেই একটি খবর নিউজফিডে ঘুরপাক খাচ্ছিল। শের আলী নামে একজন পুলিশ কনস্টেবল দুর্ঘটনায় কবলিত বাস থেকে একটি শিশুকে উদ্ধার করে হন্যে হয়ে ছুটছেন। আহত শিশুটিকে শের আলী উদ্ধারের পর তাকে “ আব্বা” বলে ডাকায় চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি তিনি। আর সেই স্থিরচিত্র যখন দূর–দূরান্তের মানুষের কাছে পৌঁছে গেলো মুহূর্তের মধ্যে, বিশ্বাস করুন কান্না চেপে ধরেছিলো গলা পর্যন্ত।
সারাটা দিন ভাবতে লাগলাম, কী নিদারুণ সত্যি যে, প্রতিটি ইউনিফর্মের বাইরে একটি আপন সত্ত্বাও থাকে, যা আপনচিত্তে লালন করে মানবতাবোধ, যা এখনও হারিয়ে যায়নি।
কনস্টেবল শের আলী কর্মরত আছেন চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশে। তিনদিনের ছুটিতে কক্সবাজারে নিজের বাড়িতে ছিলেন তখন তিনি। রোববার দুপুরে, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে বাস দুর্ঘটনার খবর শুনে তিনি সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন। আর সেখান থেকেই উদ্ধার করে আনেন উম্মে হাবিবা নামের শিশুটিকে। শের আলী ছুটিতে থাকলেও মনুষ্যত্বের খাতিরে আর মানবতার তাগিদেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন দুর্ঘটনাকবলিত মানুষের দিকে। দায়িত্ব পালন করেছেন একজন সমাজ ও দেশের একজন সুনাগরিকের। উদ্ধার কাজে অংশ নিতে কেউ তাকে বলে দেয়নি, তিনি সেখানে গিয়েছিলেন নিজের বিবেকের তাগিদে। দু সন্তানের বাবা শের আলী, তার নিজ সন্তানের সমতুল্য হাবিবাকে উদ্ধার করে ধরে রাখতে পারেননি তার আবেগ আর পিতৃপরায়ণতা। একজন শিশু সন্তানকে দেখে কেঁদেছেন উদ্ভ্রান্ত এক পিতার মতোই আর কাঁদিয়েছেন লাখো বাঙালীকে। স্যালুট জানাই শের আলীকে যিনি তার উর্দির বাইরেও বাচিঁয়ে রেখেছেন তার বোধকে।
এদিকে শের আলীর স্থিরচিত্রটির পরই দেখলাম বাংলা ট্রিবিউন প্রকাশ করলো একটি ভিডিও ফুটেজ, যেখানে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ কারো সহযোগিতায় আগুন দিচ্ছে সাঁওতালদের ভিটে-পল্লীতে। ঘটনাটি ঘটেছে গত ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। চিনিকলের আখকাটাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সূত্রপাত সাঁওতাল ও স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের মাঝে। আর এরই জের ধরে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয় সবকিছু।
অবাক লাগলো বিশ্বাস করতে যে, পুলিশের উপস্থিতিতেই দুর্বৃত্তরা আগুনে নি:শেষ করে দিচ্ছে সাঁওতালদের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু আর তারা সেখানে বাধা না দিয়ে উল্টো তারা নিজেরাও মেতে উঠলেন ধ্বংসযজ্ঞে। ইউনিফর্মে থেকে এতোটাই বেপরোয়া ছিলো পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যেখানে একটিবারের জন্যেও তারা ওইসব অসহায় আর বিপন্ন সাঁওতালদের কথা ভাবেনি।
নির্যাতিত মানুষের কান্নায় আর মাতমে গোবিন্দগঞ্জের বাতাস ভারী হয়ে উঠলে মন গলেনি পুলিশের। পুড়েছে সাঁওতালদের বসতবাড়ি আর বিসর্জিত হয়েছে সেখানকার পুলিশের ভূমিকা আর মানবতাবোধ। পুলিশের এহেন কর্মকাণ্ডে লজ্জা, ঘৃণা আর রাগে মাথা অবনত।
কত আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখালাম পিতা শের আলী আর পুলিশের মাঝে। একজন পিতা নিজে ছুটিতে থাকার পরও দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে যান আহতদের উদ্ধারের তাগিদে আর অন্যরা দায়িত্ব থাকার পরও আগুনের লীলাশিখায় কেড়ে নেয় কিছু মানুষের মাথা গোঁজার শেষ ঠাইটুকু পর্যন্ত। জনগণের নিরাপত্তা যারা দিবে, তারাই কিনা ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে মানুষের আস্থা, নি:শব্দে চাবুক মারছে বিশ্বাসে।
ইউনিফর্ম ছাড়া আর ইউনিফর্ম পরা মানুষে এতো বিভেদ, এতোটাই জলাঞ্জলি মানবতাবোধে। ধিক্কার জানানো ছাড়া আর কোন শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না ক্ষোভ প্রকাশে। এতোটাই বেপরোয়া, উচ্ছৃঙ্খল আর লাগামহীন আচরণ কী আমরা আশা করতে পারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে?
সাঁওতালরা আমাদের দেশের একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যারা ১৮৫৫ সালে প্রথম ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে পাক হানাদার বাহিনীর থেকে। ১৮৫৫, ১৯৭১ আর ২০১৬ তিনটি সময়কালেই সাঁওতালরা তাদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেতে।

ব্রিটিশদের তাড়িয়ে আর পাকিস্তানীদের হারানোর পরও সাঁওতালরা আর নিজ ভূমে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মার খেয়ে, রক্তাক্ত হয়ে, সহায়-সম্বল হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে শীতনিদ্রা যাপন করছে। আজ শুধুমাত্র সংখ্যায় কম বলে সাঁওতালদের ওপর এহেন নির্যাতন চালানো হয়েছে।
আইন যদি সবার জন্য সমান হয়, তবে পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাধের জন্যও তাদের শাস্তির বিধান করা উচিত।
পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিরা রক্ষক হয়ে ভক্ষকের কাজ করবে, আর রাষ্ট্র কী তা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবে? তাদেরকে কী আনবে না কোন শাস্তির আওতায়? আমরা কি তবে এমন দেশই চেয়েছিলাম যেখানে স্বার্থান্বেষী মহল উস্কে দিবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আর তারা পাক হানাদার বাহিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে নিরীহ মানুষদের ওপর!
সাঁওতালদের ওপর পুলিশের বর্বর আর লাগামহীন আচরণ নিয়ে কী হবে না কোন বিচারবিভাগীয় তদন্ত? প্রশ্ন রইলো জনগণের পক্ষ থেকে, রাষ্ট্র কি পারবে এর সাহসী আর বলিষ্ঠ উত্তর দিতে?