সরকার কি মৌলবাদী চক্রান্তের কাছে হেরে যাচ্ছে?

সা’দ শামীম: বিশেষ কারণ বিবেচনায় ১৮ বছরের নিচে মেয়েশিশুর বিবাহের বিধান রেখে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৬’ সংসদে উত্থাপন হয়েছে! আইনটি পাশও হবে বোধ হয়! নারীর ক্ষমতায়নে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পাওয়ার মতো একটি সময়ে পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি ও মৌলবাদী চাহিদার কাছে নতজানু হয়ে শিশুবিয়ের মতো একটি অন্ধকার আইনকে স্বাগত জানালে কী হবে, সে বিশ্লেষণ কি সরকারের কাছে আছে?

নারী উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে থাকার গৌরবোজ্জল অবস্থান থেকে পিছিয়ে যাবে বাংলাদেশ। কারণ গত পনের বছরে সরকার আর এনজিওদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অর্জন এর ছয়টিই ব্যর্থ হয়ে যাবে।

সা’দ শামীম

-মেয়ে শিশুর স্থায়ী নিরক্ষরতার হার বেড়ে যাবে, দেশে শিশু বিয়ের হার বেড়ে যাবে, মাতৃমৃত্যুর হার বাড়বে, শিশু মৃত্যুর হার বাড়বে, অপরিণত শিশু জন্ম নেবে, শিশু বয়সেই তালাকপ্রাপ্ত হয়ে সন্তানসহ বাবা-মার ঘরে বোঝা হয়ে ফেরত আসবে, দারিদ্র-চক্র শক্তিশালী হবে, বহু বিবাহ বাড়বে, শিশু নির্যাতন বাড়বে।

-শিশু ধর্ষণ (শিশুর সম্মতিতে ও যদি যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়) বৈধতা পাবে, ধর্ষক পুরুষরা রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় পাবে, আইনের আনুকূল্য পাবে।

-পরিবারে ও সমাজে শিশু ও নারী নির্যাতন ও বৈষম্য বাড়বে – নারী মর্যাদা, সমতা, ক্ষমতায়নের পথ রুদ্ধ হবে।  

-নারীকে শুধুমাত্র সেক্সটয় হিসেবে ভাবার মৌলবাদী ধর্মান্ধতার ধ্যন-ধারণা যজ্ঞদল পাথরের মত সমাজে জেঁকে বসবে। পাকিস্তান আফগানিস্তানে যেমন হয়েছে। ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী আশকারা পাবে এবং পরবর্তীতে আরো পশ্চাদপদ দাবী-দাওয়া নিয়ে হাজির হবে।

ইতিমধ্যেই হেফাজতের তের দফা আর শফি’র তেঁতুল তত্ত্বের কথা আমরা ভুলে যাইনি। এই আইন প্রকারান্তরে সেই তের দফাকে বাস্তবায়ন করবে। মৌলবাদী সংকীর্ণ চর্চার দিকে দেশকে ঠেলে দেয়া হবে। এরপর এই মৌলবাদীরা  Islamic State (IS) প্রতিষ্ঠার দাবি জানাবে? 

দেশের শীর্ষ পদে নারী থেকেও যদি আমরা নারীকে তার মর্যাদার লেন্স দিয়ে না দেখে  কেবল যৌন উপকরণ ভাবার মতো সংকীর্ণ মন-মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে না পারি, তবে এটাতো আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা। সম্প্রতি তুরস্কে ধর্ষকের সাথে বিয়ে হলে ধর্ষণের সাজা মওকুফের বিধান রেখে যে আইনটির প্রস্তাব পাশ হলো, তার সাথে এই আইনের প্রয়োগগত পার্থক্য কি আছে? মধ্যপ্রাচ্যকে আদর্শ হিসেবে সামনে রেখে তবে কি আমরা আমাদের মেয়েশিশুদেরকে পুরুষের বিকৃত যৌন চাহিদার কাছে বলি দেবো? নারীর ক্ষমতায়নের এই দেশ তবে কি ধর্ষকের অভয়ারণ্য হবে? সরকার কীভাবে এটা মোকাবেলা করবে? দেশটা কি পশ্চাদপদতা মেনে নিয়ে মেয়েদের যৌনদাসিতে পরিণত করে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো হবে? হাতে করে নারীর ক্ষমতায়নকে গলাটিপে হত্যা করা হবে?

যে সময়টাতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ ও অধিকার নিশ্চিত করে, নারীর অর্থনৈতিক দক্ষতা ও ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশকে একটি উদার কল্যাণমূলক উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সময় এসেছে, সেই সময়ে আমরা কী করে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তি দেখিয়ে এমন একটি অন্ধকার আইন করার কথা ভাবতে পারি? ধর্মীয় সংগরিষ্ঠতা কিভাবে একটি দেশের আইন প্রণয়নে নিয়ামক হতে পারে?

এই ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়েই তো আমরা নারী নীতির মুখ দেখতে পাচ্ছি না, সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না। এই ধর্মীয় অন্ধত্ব তো নারীকে স্রেফ সেক্স টুল ছাড়া কিছুই ভাবতে পারে না, মানুষ হিসেবে নারীর অধিকারকে স্বীকার করে না। এই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা সমাজকে পিছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বার বার। মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশই এই ধর্মান্ধতার কবল থেকে বের হতে না পেরে এখনো অন্ধকারে ডূবে আছে। আওয়ামী লীগ সরকারও কী সেই ধর্মান্ধ মৌলবাদী চক্রান্তের কাছে হেরে গিয়ে দেশকে মধ্যযুগে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে? 

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত একটি গ্রামের ছেলে হওয়ার সুবাদে এবং গত ১৬ বছর গ্রামের মানুষের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করার ফলে গ্রাম সম্পর্কে খুব পরিষ্কার ধারণা আছে আমার। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আজকে সরকারের এতো প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যে শিশু বিয়ে কমানো যাচ্ছে না, তার কারণ ওই ধর্মীয় গোঁড়ামি আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজপতিরা।

মেয়ে শিশু ১০-১২ বছরে পা দিতে না দিতেই ধর্মীয় কুসংস্কারের ছোবলে আমাদের দেশের গ্রাম-গঞ্জের সরল ধর্মপ্রাণ মা-বাবা পাপের ভয়ে তাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। গরীব বাবা-মা সারাক্ষণ ভয়ে থাকে তাদের মেয়ে যদি কোন ছেলে বা পুরুষের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়, ধর্ষণের শিকার হয়, মেয়ে যদি কিছু একটা করে বসে, তাহলে পাপ হবে। এই ভয় যতোটা না মেয়েটির নিরাপত্তার জন্য, তার চাইতে বেশী পাপের, গ্রাম্য ধর্মীয় নেতা ও সমাজের মানুষের হাতে অপমান অপদস্থ হওয়ার। সেই ভয়েই রাতের আঁধারে লুকিয়ে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে শিশুটিকে বিয়ে দিচ্ছে। আর সামনে বলা হচ্ছে- অভাবের কারণে বিয়ে দিচ্ছে, অন্য ছেলের সাথে প্রেম করছে, বড় হলে যৌতুক বেশী লাগে ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই সংখ্যাগরিষ্ঠ (?) গ্রাম্য ধর্মীয় নেতারা বার বার বাবা-মাকে যে পাপের ভয়  দেখিয়ে মেয়েশিশু বিয়ে দিতে বাধ্য করছিল এতোদিন, আজ সেই ভয় রাষ্ট্রকে দেখিয়ে তাহলে রাষ্ট্রীয়ভাবেই এর বৈধতা আদায় করে নিচ্ছে?   

যখন একটা মেয়েকে যৌন নিপীড়ন করা হচ্ছে, যৌতুক ছাড়া বিয়ে হচ্ছে না, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তখন ঐ ধর্মীয় কাঠমোল্লারা ঐ নষ্ট ছেলে বা পুরুষের বিরুদ্ধে কিছু বলে না। বরং ঐ মেয়ে শিশুকেই সকল দোষ চাপায় এবং মা-বাবাকে অপমান করে। সরকারও কি এদেরকেই প্রমোট করছে? যদি তা না হয়, তবে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে শিশু বিবাহের আইন শিথিল না করে বরং সমাজের ধর্মীয় কুসংস্কার রোধে ব্যবস্থা নিয়ে, আর গ্রাম্য কাঠমোল্লাদের ও নির্যাতনকারী ছেলে-পুরুষদের কঠোর হাতে দমন করাই সরকারের প্রায়োরিটি হওয়া উচিত।

প্রতিটি শিশু মেয়ের শিক্ষা, বিকাশ ও নিরাপদ জীবনের অধিকার সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে মৌলবাদী পুরুষতান্ত্রিকতাকে উপেক্ষা করে। তাহলেই বুঝবো এই সরকার জনগণের, এই সরকার প্রগতিশীল, এই সরকার নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করে।  

লেখক: সা’দ শামীম, উন্নয়ন কর্মি

শেয়ার করুন: